শিল্পের একজন অভিভাবক —– দুলাল কাটারী

শিল্পের একজন অভিভাবক
দুলাল কাটারী
জীবনের এই ক্ষুদ্র সময়টিতে বেশ কিছু মানুষের প্রভাব ইতিমধ্যেই আমাকে ভরিয়ে তুলেছে। এরকম কথার আশ্রয় নিতে হচ্ছে এই জন্য যে, আমরা যত চেষ্টাই করি না কেন প্রকৃতির সর্বশেষ্ঠ জীব মানুষকে উপেক্ষা করতে বা তার বঞ্চনার স্বীকার হয়ে ক্ষোভ উগরে দিতে, একটা সময় সেই মানুষের কাছেই আমাদের আত্মসমর্পণ করতে হয়। বারেবারে দেখেছি মানুষের কাছেই প্রতারিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত হয়ে যখন মানুষের বিরুদ্ধেই কলম চালিয়েছি তখনই দেখেছি মানুষের কাছেই ভালোবাসা পাচ্ছি আবারও। সুতরাং পৃথিবীতে কেবলমাত্র আমিই যে ভিকটিম সেটা বলা একদমই ভুল হবে, প্রত্যেকেই কারো না কারো কাছে প্রতারিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত।
আমার সাহিত্যে পথচলা শুরু করার পর থেকে অজস্র মানুষের স্নেহ, ভালোবাসা,আদর পেয়েছি।আবার অনেক ক্ষেত্রে কড়া সমালোচনার সমমুখীন হতে হয়েছে।যাঁদের কাছে ভালোবাসা পেয়েছি বা এখনো পাচ্ছি তাঁদের যেমন শতসহস্র প্রণাম করি, যাঁদের কাছে সমালোচিত হয়েছি তাঁদেরও সশ্রদ্ধ স্মরন করি বারবার। আজকের দিনে সমালোচনার কথা বলতে গেলে যেন একটু বেশিই বলতে হবে কারণ সোশাল মিডিয়ার যুগে একেঅন্যের সমালোচনায় একটু বেশিই মগ্ন। তখনকার দিনে কোথায় কোন্ কবি-সভায় বসে জনা পনেরো কবি পুকুর ঘাটে মেয়েলী কানাকানির মতো অন্য কয়েকজনের ধুতির কাছা ফসকে কোন্ কোন্ অশালীন শব্দ বেরিয়ে পড়লো বা ভাবধারাটা পশ্চিম মুখে প্রবাহিত হয়ে বৌঠানের আঁচল উড়িয়ে না দিয়ে বরং দক্ষিণ দিকের জানালা পর্যন্ত পৌঁছালেই ভালো হতো — এ-সব নিয়ে আলোচনা করলেও সেটা কিন্তু কোনো লেখককে সবসময় প্রত্যক্ষ করতে হতো না বরং এসব নিয়ে ততটা ব্যতিব্যস্ততাও ছিলো না এবং সম্মুখ যুদ্ধের বিষয়টিকে চাইলে এড়িয়ে চলা যেতো।কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এই সমালোচনার বাড়বাড়ন্তটা অনেকটাই বেশি এবং সবসময় পোস্টে আসা মন্তব্য গুলোর সঙ্গে তথা মন্তব্য কারি কিছু সংকীর্ণ মনস্ক মানুষের সঙ্গে সরাসরি লড়াই করতে হয়– এরকম অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে,তবে ভালো ফলনের জন্য হয়তো এসবেরও প্রয়োজন আছে খুব বেশি।
যাইহোক,এগুলোর সঙ্গে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। কিন্তু যে বিষয়টির জন্য আমার আজকের কলমের কালি খরচ করা সেই বিষয়টি হলো ভবতোষ দাস। হ্যাঁ, ভবতোষ বাবুকে ব্যক্তি না বলে বিষয়ই বলছি। যিনি এক সমুদ্রের মতো আধার, তাঁকে শুধুমাত্র ব্যক্তিত্বের গন্ডিতে আটকে রাখা অনুচিত বলেই মনে করছি।যুগাভিমুখী তাঁর কাব্য ধারা,শিরায় শিহরণ জাগানো বাচিক কন্ঠ, মঞ্চ সফল নাট্যাভিনয়,সর্বোপরি বেতার ও টেলিভিশনে সুদীর্ঘ পথচলা তাঁর ব্যক্তিত্বে বলিষ্ঠতা এনেছে।
তিনি আমাকে বারেবারে ভাষা প্রয়োগের বিষয়ে শুধুমাত্র সমালোচনা করেই পিছপা হন নি, হাত ধরে শিখিয়ে দিতেন এবং এখনও দেন কিভাবে শব্দ প্রয়োগ করতে হয়।মাথার উপরে এমন এক অভিভাবক থাকলে এবং আমার প্রতিটি লেখাতে তাঁর দৃষ্টি পড়লে অথবা মূল্যায়ন এলে আমিও লেখার সময় সর্বদা সচেতন থাকি অপ্রাসঙ্গিক বা অবাঞ্ছিত কিছু যেন এসে না পড়ে লেখার মধ্যে।
আসলে লেখার সময়ে লেখা কোন্ দিকে মোচড় খাবে সেটা আগে থেকে অনুমান করা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া একটা কথা খুব কড়া ভাষাতে না বলে একটু নমনীয়তার ছোঁয়াতেই বলে রাখি সব কবিতা যে আকাশ-বাতাস-পাহাড় এসবের কল্পনায় লেখা হবে আর সব কবিতাই যে রোমান্টিক বা প্রেমের কবিতা হবে এবং সেই কবিতার ভাষা রবীন্দ্রনাথের মতো একজন জমিদার নন্দন কবির প্রেম প্রনয়ের নমনীয় ও আবেদনময়ী ভাষা হবে তা কিন্তু না-ও হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে ক্ষুধার জ্বালা নিবারনের জন্য মানুষের চিৎকারকেও কবিতার ভাষা দিতে হয় বা অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে লড়াই সেই লড়াইকেও কবিতায় জায়গা দেওয়া হয়।সুতরাং সমালোচকদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে সবজায়গায় সুস্থ, স্বাভাবিক, শালীন শব্দ প্রয়োগের আশা করা উচিত নয়।কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়বে না।শাসক কোনো দিন সহজে সুযোগ সুবিধা দেবে না সাধারণ মানুষকে। তাই তখন বলতেই হবে “দিবিনে কেন রে শালা?”
এটা তিনি( ভবতোষ দাস) জানেন বা মনে প্রাণে উপলব্ধি করেন।তাই আমার ক্ষুধার যন্ত্রণার চিৎকার বা অধিকার অদায়ের অশালীন ভাষা গুলিকে তিনি তিরস্কার করে দূরে ফেলে না দিয়ে একটু গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেন যেন। আমার বেশ কিছু লেখাতে তথাকথিত অশালীন বলে পরিচিত কিছু শব্দের প্রয়োগ দেখেও এতো বড়ো মাপের একজন বাচিক শিল্পী ( আন্তর্জাতিক ভরত পুরস্কার প্রাপ্ত, প্রদান হিন্দুস্তান আর্ট এন্ড মিউজিক সোসাইটি ) সামান্য তরুণের এক উঠতি কলমের কান্নাতে কন্ঠ মেলালেন। করোনা কালের শুরু তে আমার লেখা কবিতা ‘লাশ বয়ে নিয়ে যায় লাশে’ লেখাটিতে প্রথম কন্ঠ সঞ্চালনা করলেন তিনি। পাঠকের মনে এতোটা প্রভাব বিস্তার করবে তা আমি কল্পনাও করি নি।তারপর আরো দীর্ঘ পথচলা আমাদের একসাথে বেশ কিছু কাজের মধ্য দিয়ে।
ছোট থেকে তিনি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বড়ো হয়ে বেকার জীবন এবং বেসরকারী চাকরি জীবন সামলেও লেখা-লেখি ও আবৃত্তি-নাটক বজায় রেখেছেন,আবার সরকারি চাকরি করতে করতেও সমানতালে শিল্প চর্চা চালিয়ে যাওয়া বা এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন সেটা একটা সাংস্কৃতিক সংগ্ৰামী ইতিহাস বলা যায়।
এই ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তিনিও কখনও কখনও বঞ্চিত হয়েছেন বা রাজনৈতিক ভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন। সরকারি দপ্তরের অধীনে কাজ করার সময়ে তাঁর প্রতি একাধিক রাজনৈতিক আক্রমন বা বঞ্চনা হয়তো এই মানুষটির চরিত্রেও কিছুটা কাঠিন্য এনেছে। তাই তো তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম দিয়েছেন ‘নগ্নতা ভালোবাসি’।
১৯৮৩ তে শিলিগুড়ি এবং১৯৭৪ ও ১৯৯৩ তে দুবার কলকাতা বেতারে পাশ করে বেতার নাটকে অভিনয় করা,তৎকালীন যাত্রা শিল্পকে আঁকড়ে ধরে ভালোবাসা,একের পর এক মঞ্চ নাটকে অভিনয় করা,
আর আজকের দিনে অবসর জীবনের এই পোড়খাওয়া বয়সেও এখনও বহু লেখাতে তাঁর কন্ঠ সঞ্চালনা করা আমাকে ভাবায় এবং ঈর্ষা মণ্ডিত সাহস যোগায়।
অ্যাকাডেমি অফ বেঙ্গলি পোয়েট্রি আয়োজিত( ২৩ শে ফ্রেবরুয়ারি ২০০৯) কবি ও বাচিক শিল্পী হিসেবে পাওয়া সারস্বত সম্মানে ( প্রদান রাজ্যপাল কর্তৃক) সম্মানিত হয়েছেন। চলচ্চিত্র বা দূরদর্শনে তিনি অনিল চট্টোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞানেশ মুখার্জি, প্রমুখ সনামধন্য ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে কাজে তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি পরিপূর্ণ হয়েছে।
রেডিও অভিনয় করার সময়ে পেয়েছেন বিখ্যাত অডিও শিল্পী জগন্নাথ বসু, মনু মুখোপাধ্যায়, অনামিকা সাহা, দেবাশীষ বসু, দেবরাজ রায়, রামজীবন মিত্র, আশীষ গিরি প্রমুখ ব্যক্তিত্বকে।শ্রীকান্ত আচার্যে সঙ্গে সিডি রেকর্ড এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মঞ্চ সেয়ার করা; কলকাতার মঞ্চ, লক্ষৌ এর মঞ্চ, মধ্য প্রদেশর মঞ্চ, শিলিগুড়ি – বর্ধমান ও হুগলি – বাঁকুড়ার বিভিন্ন সামিয়ানার তলে নাটক ও আবৃত্তির মাধ্যমে শিল্পের স্বাক্ষর রেখেছেন, যা সত্যিই অভাবনীয় তা তাঁর শংসাপত্র ও পুরস্কারের ডালি প্রত্যক্ষ করলেই বোধগম্য হয়।
সুতরাং তাঁর শিল্প স্বত্ত্বায় যে অনেক মানসিক উত্তোরণ হয়েছে তা বলাবাহুল্য। বহু বাধাবিপত্তির তোয়াক্কা না করে স্বমহিমায় উজ্জ্বল তিনি।
তাঁর আশীর্বাদ ও স্নেহময় ভালোবাসা আমাকে যেন দীর্ঘ পথের অনুসারী করেছে।
কোনো একসময় আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁকে একটি প্রশ্ন করেছিলাম যে তিনি এই বয়সেও আবৃত্তি বা শ্রুতি শিল্পকে এতোটা গুরুত্ব দিয়ে চলেছেন তথা জীবনের অংশ করে নিয়েছেন এতে তার শারীরিক-মানসিক ক্লান্তি আসে কি-না? তিনি জানান –এটা তাঁকে সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে, অনেক গঠনমূলক আড্ডার সুযোগ করে দেয়, আলোচনার মুহূর্ত এনে দেয়, অনেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে মিশিয়ে দিতে সুযোগ করে দেয়,মানুষের ভালো লাগাতে তাঁর মনে পরিতৃপ্তি আসে এবং এটাই তাঁর যেন সমাজের প্রতি সেবামূলক অঙ্গীকার।এই সবের মধ্যে দিয়ে তিনি যেন শিল্পের এক নতুন দিক উদ্ঘাটন করে চলেছেন এবং অভিভাবকের ভূমিকা পালন করছেন এই বয়সেও,শব্দ নিয়ে খেলা করা যাঁর নেশা অথচ শিল্পটিকে পেশা হিসেবে মেনে নিতে পারেন নি,তাঁর সম্বন্ধে যতই বলি খুব কমই বলা হয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার কয়েকটি মিডিয়া তাঁর কাজ নিয়ে খুবই আগ্রহ প্রকাশ করছে, খুব ভালো লাগছে, যোগ্য ব্যক্তিই যোগ্য সম্মান পাচ্ছেন। সমাজ উপকৃত হচ্ছে– এর বেশি আর কি-ই বা চাওয়ার থাকে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *