“রক্ত ঋণ” সফিক আহমেদ

“রক্ত ঋণ”

সফিক আহমেদ

চারিদিকে শ্বেতশুভ্র তুষারপাতের মধ্যে, রাত্রের রাস্তার ঝলমলে আলো তৈরী করেছে এক অপার্থিব পরিবেশ।
টরন্টো সানিব্রুক হেল্থ সাইন্স সেন্টার এ ট্রমা ইউনিট, অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ একেবারেই ব্যস্ত নয়।
সিনিয়র নার্স মেরি, রাতের ডিউটি তে ডিউটি রুমের জানলা দিয়ে অলস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর ফিরে যাচ্ছে তার ফেলে আসা দিনপঞ্জিকার ছেড়া পাতায়।
অনিন্দ্য আর মারিয়াম নস্কর অভিবাসন নিয়ে নেমেছিল টরন্টো এয়ারপোর্ট এ নতুন দেশে নতুন জীবন শুরু করতে।
সে রাত্রে নতুন শহরে সব ই অচেনা। শুধু চেনা লেগেছিলো আকাশের একথালা পূর্ণিমার চাঁদ।
অনিশ্চিত পরিবেশে পরম স্নেহে ত্রস্ত মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে ছিল এই চাঁদের আলো।
দেশের প্রতিষ্ঠিত জীবন ছেড়ে এসে, একটা পরিণত গাছকে সমূলে উৎপাটিত করে নতুন জায়গায় প্রতিস্থাপন করার অভিঘাত সহ্য করে, ধীরে ধীরে দুজনেই শুরু করেছিল জীবন যুদ্ধ।
দেশের টাকা মুদ্রাবিনিময়ে হ্রাস পাওয়ার ধাক্কা , দেশের শিক্ষাগত যোগ্যতার স্বীকৃতি পাওয়ার যুদ্ধ আর কোনো কাজ শুরু করার জন্য এই দেশের কাজের অভিজ্ঞতার অন্যায় প্রয়োজনীয়তার গোলক ধাঁধায় ঘুরতে ঘুরতে অস্থায়ী কাজ দিয়ে শুরু হয়েছিল এই দেশের মুদ্রা উপার্জন।
দুজনের উপার্জন এ আস্তে আস্তে এসেছিলো স্থায়িত্ব।
বাসস্থান, গাড়ি সব ই হয়েছিল আর অনিন্দ্য ও পেশাগত যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পেয়ে যাওয়ায় সংসারে নতুন মুখের আগমন হয়েছিল। এসেছিলো আরিয়ান।

চিন্তার রেশ ছুটে গেলো অ্যাম্বুলেন্স এর আওয়াজ, আলো আর সিনিয়র সার্জনের ডাকে । নির্লিপ্ত দক্ষতায় অপারেশন থিয়েটার এ সাহায্য করা, রক্ত স্যালাইন দিয়ে রোগীকে বেড এ স্থানান্তরিত করা, রিপোর্ট লেখার পর হাতমুখ ধুয়ে, এক কাপ কফি নিয়ে বসলো মেরি আর আনমনা হয়ে নিজের জীবনকেই ছায়াছবির ফ্লাশব্যাকের মতো দেখতে শুরু করলো আবার।
মনে পরে গেলো নতুন কাজে দিন দিন উন্নতির সাথে অনিন্দ্যর পরিবর্তন,
অফিস জগতে অনিন্দ্য থেকে Andy হয়ে ওঠা ,দিন কে দিন কাজ,
কাজের পর অফিস কলিগদের সাথে পার্টি , নাইট ক্লাব নিয়ে ডুবে থাকা ।
ছোটখাটো কাজ আর আরিয়ানকে দেখভাল করেই কাটতো মারিয়ামের দৈনন্দিন জীবন।
দিন কে দিন হারিয়ে যাচ্ছিল পারস্পরিক আস্থা, হচ্ছিল ছন্দপতন।
Andy ডলারের মোহে নতুন নতুন ব্যবসায় টাকা লাগাতে শুরু করলো।
বৈধ অবৈধ বিচার নির্বিশেষে রাতারাতি বড়োলোক হওয়ার মোহে জড়িয়ে পড়লো
মোহিনী সারিনা আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের পাল্লায়।
এক মাসে ইনভেস্টমেন্ট দ্বিগুন হচ্ছিলো, জেনে ও জানতে চাইছিলনা কোন অসৎ উপায়ে এই টাকা আসছিল।
সঙ্গে সঙ্গে চলছিল সংসারের অবহেলা।
আরিয়ানের জন্মদিন ভুলে যাওয়া, বিবাহ বার্ষিকী ভুলে যাওয়া সব ই গা সওয়া হয়ে যাচ্ছিল মারিয়ামের।
ডলারের চাকচিক্যে হারিয়ে যাচ্ছিল সেই চেনা অনিন্দ্য।
মারিয়ামের জীবনে, সিনেমা টেলিভিশনের গল্পই যেন ঢুকে পড়ছিলো সত্যি হয়ে ।
ইনভেস্টমেন্ট এর জন্য ধার করা , সেই টাকা শোধ করার জন্য আরেকজায়গায় ধার , ponzy স্কিম এ লোকজনকে প্রতারণা করা , একটু আধটু ড্রাগ, এই আবর্তে ডুবতে শুরু করেছিল অনিন্দ্য।
আরিয়ান কে একাই বড় করছিলো মারিয়াম।
৬ বছর বয়সে প্রথম স্কুল এ যাওয়ায় ও অনিন্দ্যর উপস্থিতি পাইনি আরিয়ান।
স্কুল বাস এ ফেরার পথে এক্সিডেন্ট এ প্রচুর রক্তপাত হওয়াতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়
আরিয়ান সহ আহত স্কুলের বাচ্চাদের।
স্কুল থেকে খবর পেয়ে হাসপাতালে গিয়ে অনিন্দ্যকে ফোন করে ও ফোন পাইনি নেশায় মত্ত অনিন্দ্যর থেকে । হাসপাতাল জানায় আরিয়ান এর AB নেগেটিভ ব্লাড গ্রুপ। এই বিরল গ্রুপের রক্ত দুষ্প্রাপ্য।
ইমার্জেন্সি হলে রক্ত সংগ্রহ করতে হবে।
দিশেহারা অবস্থায় সব ব্লাড ব্যাঙ্ক এ যোগাযোগ করেও পাইনি এই রক্ত।
ভগবানের অসীম কৃপায় এই যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিলো আরিয়ান।
বাড়ি ফিরে এক মাস পর যখন আবার স্কুল এ যেতে শুরু করলো , মারিয়াম কাজ ছেড়ে নিজেই নিয়ে যেত স্কুল এ।
সংসার চালাতে হাত পাততে হতো অনিন্দ্যর কাছে। জোড়া তালি দিয়ে চলছিল সংসার।
এক রাতের মেলোড্রামাটিক পরিবেশেই শেষ হয়ে গেলো নতুন দেশের পাতানো সংসার।
মধ্য রাত্রে সারিনাকে নিয়ে মত্ত অবস্থায় ঘরে ঢুকে বললো আজ থেকে সারিনা এখানেই থাকবে ,
তোমরা বেরিয়ে যাও ঘর থেকে।
একদিন যেমন দেশ থেকে বেঘর হয়ে এসেছিলো নতুন দেশে নতুন ঘর বসাতে আজ আবার আরিয়ান কে নিয়ে নতুন জীবন সংঘর্ষ শুরু।
মারিয়াম নয়, পর দিন সকালে পুলিশ এর সাহায্যে অনিন্দ্যকেই ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স এর অভিযোগে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল বাড়ি থেকে।
সেই শেষ দেখা অনিন্দ্য কে।
সোশ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স , চাইল্ড বেনিফিট আর অস্থায়ী কাজ নিয়েই চালাতে হচ্ছিলো মারিয়াম আর আরিয়ানের ছোট্ট সংসার।
কমিউনিটি হেলথ কেয়ার সেন্টার এ আরিয়ানের চেক আপ করতে গিয়ে আলাপ হয় সৌম্য দর্শন পিতৃপ্রতীম ডাক্তার জোসেফ নিকোলাস এর সাথে। ডাক্তার জোসেফ এর উপদেশে আর সহায়তায় হাম্বার কমিউনিটি কলেজ এ নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট এর শর্ট কোর্স থেকে শুরু করে, নার্সিং হোম এ পার্ট টাইম কাজ থেকেই তার একার জীবনে সাবলম্বী হওয়ার উড়ান শুরু।
দীর্ঘ ১৭ বছর পর মারিয়াম আজ টরন্টো সানিব্রুক হেল্থ সাইন্স সেন্টার এ ট্রমা ইউনিট এর সিনিয়র নার্স মারি।
আরিয়ান ডাক্তারি স্টুডেন্ট। আরিয়ানকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া মাকে আজ হাসপাতালে পৌঁছে দেয় আরিয়ান
আর ডিউটি শেষে নিতেও আসে। আসতে মানা করলেও ও শোনেনা মারির গার্জেন আরিয়ান।
চিন্তার রেশ কেটে যায় শেষরাত্রে এম্বুলেন্সএর সাইরেন আর ওয়ার্ড বয়দের ছোটাছুটি তে।
EMS থেকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল হাইওয়ে ৪১০ এর বরফ ঢাকা রাস্তায় পিছলে একটা গাড়ী খাদে পড়ে, গুরুতর আহত চালক আর মৃত তার সঙ্গিনী।
অপারেশন থিয়েটার এ তৈরী ছিল মারি আর ডিউটি সার্জেন।
স্ট্রেচার যখন ঢুকলো মুখ, হাত আর দেহের উর্ধাংশ এ মাল্টিপল ফ্র্যাকচার , আর রক্তক্ষরণে মুমূর্ষু আহত চালক কে নিয়ে আর দেরি না করে সার্জেন শুরু করলো ইমার্জেন্সি অপারেশন।
স্বভাবসিদ্ধ দক্ষতায় সার্জেন কে সহায়তা করে মারি রক্তের নমুনা নিয়ে ছুটলো হাসপাতাল ব্লাড ব্যাঙ্ক এ পরীক্ষা করে রক্ত আনতে ।
ব্লাড ব্যাঙ্ক জানালো রেয়ার ব্লাড গ্রুপ AB নেগেটিভ নেই।
সার্জেন এর মতে আর ঘন্টা চারেকের মধ্যে রক্ত না দিতে পারলে রোগী কে বাঁচানো যাবে না।
সব ব্লাড ব্যাঙ্ক এ এলার্ট করে ডিউটি রুম এ ফিরে গিয়ে যখন বসলো মারি
তখন ভোরের আলো ফুটেছে আর ডিউটি ও শেষ।
আরিয়ান এসেছে মাকে নিতে।
বেরোনোর আগে আর একবার রোগীর অবস্থা দেখতে গেলো মারি।
সার্জারির পর মুখের চেহারা অনেকটা বোঝা যাচ্ছে।
একঝলক দেখে নেমে এসে আরিয়ানের গাড়িতে উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট করার আগে
আরিয়ান এর হাত চেপে ধরে বললো যা রক্ত ঋণ শোধ করে আয়।
রক্ত দান করে আয় মৃত্যু পথযাত্রী রোগীটার জন্য!!!
*সমাপ্ত*
সফিক আহমেদ
হিউস্টন, টেক্সাস , ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *