প্রথম কৃষ্ণচূড়া মৌসান
প্রথম কৃষ্ণচূড়া
মৌসান
এত মন খারাপ করা পরিবেশ! দিনগুলো যেন কাটতেই চাইছে না! তবে আজ আমি দারুণ দারুণ খুশী। কেন? সেই গল্পই শোনাচ্ছি তোমাদের।
কৃষ্ণচূড়া গাছ। লাগিয়েছিলাম টবে। একপ্রকার জেদ করেই। কি জানি কেন এত ভালো লাগে এই গাছটাকে।
সব বাঙালিরই বোধহয় আমার মতোই অনুভূতি হয়। শেষ বসন্তে চোখ ঝলসে দেয় লাল-কমলা-হলুদ রঙের বাহার।
একটা দশ বাই বারো ফুটের ঘর; দুটো জানালায় ছোট্ট বাগান ছিল আমার।
একটাই টবে দুটো গাছের মধ্যে চলতো প্রতিযোগিতা; কে আগে বড় হবে!
অনেকটা সিমের মত দেখতে বীজ থেকে দুটো চারাগাছ বেরিয়েছিল।কচিকলাপাতা রঙের পাতার ঝাড়! আমার অন্যতম প্রিয় রঙ।
তারপর দিন, মাস বছর ঘুরতে থাকলো। অনেক ভাঙাগড়া, কতো মান-অভিমান, অনেক হাসি-কান্না, পরিমিত-অপরিমিত আদর-ভালোবাসার সাক্ষী হতে থাকলো আমার কৃষ্ণচূড়া। বসন্ত কাল এলেই প্রত্যাশা জাগতো। একবার তো রাগ করে লিখেই ফেললাম, প্রশ্ন করেছিলাম, “কৃষ্ণচূড়া, তুই কি আমার মতোই নিষ্ফলা হয়ে রয়ে যাবি?”
তারপর একদিন মায়ের হাতে তুলে দিলাম ওদের। সেই জানালা এখন অতীত। আমার কাছে; ওদের কাছেও। আমাদের বাড়ির নীচে, গ্যারেজের পাশে, বাইরের পাঁচিলের ধারে, একটা চৌবাচ্চা মতো করে মাটি ভরা থাকে। মা সেখানে জবা, চাঁপা,নিম আরো ঐ চাইনীজ বাঁশ গাছ ইত্যাদি পুঁতে রেখেছিল। অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের বেজায় আপত্তি। আমরা পাত্তা দিইনি। ওখানেই একটা কোনায় পাঁচিল ঘেষে লাগানো হলো গাছ দুটোকে। তরতর করে বাড়তে থাকলো তারা। অনেক মাটি পেয়েছে। মাথার ওপর খোলা আকাশ পেয়েছে। ওদের আর পায় কে?
তারপর মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে কিছুদিন নার্সিংহোমে ভর্তি হলো। আমরা মাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। কোন গাছের দিকেই নজর ছিল না আমাদের। বাড়ি ফিরে খানিকটা সুস্থ হয়ে একদিন ভোরবেলা মা নীচে গিয়েছিল গাছের পরিচর্যা করতে। ফিরে এসে তো মায়ের ভীষন মন খারাপ। কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, “দেখ তোর কৃষ্ণচূড়া গাছটা কে গোড়া থেকে কেটে দিয়েছে।” ছুটলাম দেখতে।
কি নৃশংস ভাবে কেটেছে ছোট গাছটা! কার কাজ? বাইরের লোক তো করবে না। আমাদের ওপরে চারতলার ফ্ল্যাটে একটি অতি হিংসুটে লোক আছে। এটা নিশ্চয়ই তারই কাজ।
আমার মা অত্যন্ত সহজ সরল। একদিন ঐ ভদ্রলোককে বলেই দিল। “আপনি পারলেন ওভাবে গাছটা কাটতে…গাছটা এক কোনায় ছিল। সমস্ত ডাল তো রাস্তার দিকে…আপনার কি ক্ষতি করেছিল?”
সেই লোক বললেন, “বেশ করেছি। বৃষ্টি হলে ওর ডালগুলো থেকে জল আমার গাড়ির মাথায় পড়ে। রঙ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তারপর কাকেরা ডালে বসে নোংরা করে। ডেকে ডেকে আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়…আমার তো ইচ্ছা ছিল বড়টাকে খতম করে দেবার…”
আজ এই যে এত অক্সিজেনের অভাব হচ্ছে; দায়ী যেই হোক না কেন! এই সকল মানুষগুলো থুড়ি অমানুষগুলোর পাপের ফল। ঈশ্বর এদের শাস্তি দেবেন না? প্রকৃতি মা রুষ্ট হবেন না?
যাইহোক আমার মা ওনাকে একপ্রকার থ্রেটই দিল; সঙ্গে আমিও। ” এরপর একটা গাছে হাত দিয়ে দেখুন পরিবেশ আদালতে কমপ্লেন যদি না করেছি।”
যাই হোক, বড় গাছটার ক্ষতি করতে পারে নি। সে এখন তার ডালপালা ছড়িয়ে আরো সুন্দর হয়েছে। বর্ষার রাতে হলুদ আলো আর বৃষ্টির জলের ফোঁটার সঙ্গে তার সখ্যতা আমায় কতো কবিতা লিখিয়েছে। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত্য তার বিভিন্ন রূপ; হাওয়ার সঙ্গে দোল খাওয়া আমার মনকেও নাড়া দিয়ে গিয়েছে কতবার; বারবার।
কিন্তু বসন্তকাল পেরিয়ে গেলেই মন কেমন করতো। ওতে কি আর ফুল ফুটবেই না? অপেক্ষা। অপেক্ষা। অপেক্ষা। বড়ো দীর্ঘ ছিল সে অপেক্ষা আর ততোটাই মধুর।
আজ এতোগুলো বছর পরে সে দুটি ফুল দিয়েছে! কি লিখবো? দুটি ডিপ কমলা রঙের; নানা লাল রঙের; আরে নানা দুটোরই মিশ্রনে এক অদ্ভূত সুন্দর রঙের সৃষ্টি হয়েছে। নীল আকাশের নীচে, ঘন সবুজ পাতার মাঝে সে ফুল অবশেষে মৃদু হাওয়ায় দুলছে। দেখলাম। দেখতেই থাকলাম।
প্রায় দিনই ঘুমোতে রাত হয় আর উঠি বেশ দেরীতে। আজ অনেক দিন বাদে আমার খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে; ভাগ্যিস ভাঙলো। নইলে আমার ডিভাইনের আশীর্বাদে প্রকৃতি মায়ের এত বড় সারপ্রাইজটা মিস হয়ে যেত! মেডিটেশান সেরে চায়ের কাপ হাতে যেই ব্যালকনিতে বসেছি, ওমনি চোখ চলে গেল ওদিকে। “আরে ওটা কি? রঙটা ভারী চমৎকার তো!” হারিয়ে গেলাম ক্ষণিকের জন্য। তারপর চমকে উঠলাম।
“আরে ওটা তো কৃষ্ণচূড়া ফুল! আমার সাধের কৃষ্ণচূড়া গাছের প্রথম ফুল!”
গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহের মাঝে এক টুকরো বসন্তের ছোঁয়া। অসময়ে হঠাৎ বসন্ত এলো আর মনে দোলা লাগবে না? তাই কখনো হয় বুঝি?
“তোমার কাছে ফাগুন চেয়েছে কৃষ্ণচূড়া
তুমি তাই দুহাত ভরে দিলে আগুন উজাড় করে
সেকি তোমার অহংকার…?
তোমার কাছে ফাগুন চেয়েছে কৃষ্ণচূড়া…”