ইতিহাসের আলোকে কিরাত ভূমি —— গৌতম নাথ
ইতিহাসের আলোকে কিরাত ভূমি
গৌতম নাথ
প্রাচীনকাল থেকেই ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ অঞ্চলে একটা সমৃদ্ধ জনপদ ছিল ৷ দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার বিভিন্ন স্থানে এখনও তার প্রচুর ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে ৷ এই জেলার বিলোনিয়া মহকুমার বিস্তীর্ণ জনপদ দীর্ঘকাল থেকেই অনেক সমৃদ্ধ ৷ এই শহরকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ জনপদ ৷ এই মহকুমার বিস্তৃতি হলো পশ্চিম দিকে পশ্চিম পাহাড় ও দক্ষিণে বিস্তৃত নলুয়া পর্যন্ত।
‘রাজমালা’ এবং অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থে মতাই, রাজনগর, মুহুরী নদী, লাউগাঙ, ফেনী নদী সহ এই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের উল্লেখ আছে ৷ রাজন্য আমলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে সোনামুড়া বিভাগের উপবিভাগ হিসেবে বিলোনিয়াতে রাজাদের একটি কার্যালয় গড়ে ওঠে ৷ এই সময় দক্ষিণের সাব্রুমসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিলোনিয়া উপবিভাগের অধীন ছিল ৷ পরবর্তী সময়ে উনিশশো দশ সালে সাব্রুমে আর একটি উপবিভাগ চালু হয় ৷
‘রাজমালা’ অনুসারে বাংলার ইতিহাসের মধ্যযুগের কাল থেকে পরবর্তী সময় পর্যন্ত ত্রিপুরার রাজাদের সঙ্গে বাংলার সুলতানদের যুদ্ধবিগ্রহ এবং সমঝোতার উল্লেখ আছে ৷ পরবর্তী সময়ে ইংরেজ আমলের কথাও ত্রিপুরার রাজন্য ইতিহাসের তথ্য রাজমালায় রয়েছে ৷ পাশাপাশি প্রাচীন আরাকানের সাথে ত্রিপুরার রাজার সম্পর্ক, যুদ্ধবিগ্রহের কথাও এই গ্রন্থে পাওয়া যায় ৷
যদিও মতাই, লাউগাঙ, ,মুহুরীনদী ইত্যাদি নাম রাজমালায় উল্লিখিত কিন্তু সন্নিহিত প্রাচীন জনপদ পিলাকের কোন উল্লেখ সেখানে নেই। অথচ ত্রিপুরার প্রাচীন রাজাদের রাজত্ব করার কথা কোথাও কোথাও উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে পিলাক এর নামটি কোথাও উল্লেখ করা হয় নি। কিন্তু একথা স্বীকার না করলে হয় না যে দক্ষিণ ত্রিপুরার জোলাইবাড়ি সংলগ্ন ‘পিলাক’ একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ৷ অবশ্য ত্রিপুরার রাজপরিবারের সন্তান সমরেন্দ্রচন্দ্র দেববর্মণ তাঁর ‘ত্রিপুরার স্মৃতি’ গ্রন্থে পিলাকের বিভিন্ন মূর্তি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন ৷ এটাও আনন্দের কথা যে পরবর্তী সময়ে আরও অনেক গবেষকরা পিলাকের উপর প্রচুর লেখালেখি করেছেন ৷ ভারতের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে এই অঞ্চলে খোঁড়াখুঁড়ি করে প্রচুর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ধার করেন ৷
যাই হোক ,এখানকার শ্যামসুন্দর টিলা, দেব বাড়ি, ঠাকুরানির টিলা, বালির পাথর, বাসুদেব বাড়ি ও সাগর দেবা খুঁড়ে দেখা যায়, পাথর কেটে গড়া ভাস্কর্য ও টেরাকোটা ফলক ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন এলাকায়। এসব খনন স্থানে পাওয়া যায় পাথরে খোদাই করা অনেক ছবিও।
এসব ভাস্কর্য ও ছবির শিল্পরীতি বাংলার পাল ও গুপ্ত আমলের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ । তবে আরাকান ও বার্মার সঙ্গে স্থানীয় শিল্পরীতির অভূতপুর্ব মিশেলও দেখা যায় এসব প্রত্নবস্তুতে।
খুব সম্ভবত ৮ম ও ৯বম শতকে সভ্যতার বিকাশ ঘটে এখানে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকালে এখানে পাওয়া প্রত্নবস্তুগুলোতে শিব-সূর্য-বৈষ্ণবীর সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের অভূতপূর্ব সহাবস্থান দেখা গেছে। যা থেকে ধারণা করা যায়, ধর্মী সম্প্রীতির বীজ অনেক গভীরে প্রোথিত ছিলো প্রাচীন ত্রিপুরায়।