তীর্থের পথে পথে কোয়েলীর সাথে
তীর্থের পথে পথে কোয়েলীর সাথে
গুপ্ত বক্রেশ্বর বা পুরাতন বক্রেশ্বর
পরদিন কথা ছিল বাড়ি ফেরার কিন্তু ফেরা হল না । ভাই বলল –চল , দেখে আসবি গুপ্ত বক্রেশ্বর বা পুরাতন বক্রেশ্বর । বক্রেশ্বর তো অনেকে দেখেছে কিন্তু গুপ্ত বক্রেশ্বর কেউ কি দেখেছে ? সত্যি ,বেড়ানোর লোভে রয়ে গেলাম ।পরদিন ভোরে বাবা ,মা , ভাই ,ভাই-বউ মিলে গাড়ি করে চললাম পুরাতন বক্রেশ্বর ।
দুপাশে উদাস রুক্ষ মাঠ ,আখখেত ,সরষে খেত পেরিয়ে গাড়ি চলল রাঙা মাটির পথ ধরে । নওপাড়া, খয়রাশোল গ্রাম পেরিয়ে রাস্তা ভুল হয়েছিল ।আবার জিজ্ঞাসা করে করে গাড়ি চলেছে ।ডানদিকে হিংলো ড্যাম , সেই পথ ধরে যেতে যেতে দেখি লেখক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত স্কুল , স্মারক যিনি এই রাঢ় ভুমির মানুষদের দুঃখ দুর্দশা নিয়ে লিখেছেন ।
বীরভূম জেলার খয়রাসোল ব্লকের লোকপুর থানার অন্তর্গত দেবগঞ্জ গ্রাম ।তারই কাছে এই পুরাতন বক্রেশ্বর ।
আমার ভাবনার মধ্যেই গাড়ি এসে থেমেছে পুরাতন বক্রেশ্বরে ।
এ এক শান্ত তপোভুমি ,দুদিকে গাছপালার ছায়া ,মাঝে পথ ।
বেশ কিছু আগেই এসেছে ভক্তের দল । নির্জন এই আশ্রমটি শ্রীশ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর । তিনি এখানে সাধনা করেছেন । ভেতরে তাঁর ছবি আর সেই পরম্পরার সাধু মহারাজদের । আশ্রমটি যিনি দেখাশোনা করেন সেই শ্রীদামা মহারাজের সাথে আলাপ হল । প্রণাম করে এই আশ্রম সম্পর্কে জানতে চাইলাম । তিনি জানালেন –অষ্টাবক্র মুনি প্রথমে এখানেই সাধনা করেছেন তারপর তিনি বক্রেশ্বর গিয়েছেন । এই একটি কুণ্ড , যেখানে সবসময় জল পড়ছে ।শীতকালে জল ঈষদুষ্ণ কিন্তু গরমকালে শীতল হয়ে যায় । পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই ।কুণ্ডের জল স্পর্শ করি । গাছের ছায়া এসে পড়েছে কুণ্ডের জলে ,মাঝে মাঝে আলোর নাচন ।
আগে ছিল পর্ণ কুটির ,অনেক পরে এই আশ্রম তৈরি হয়েছে । পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে তিনি দায়িত্বে আছেন । ততক্ষণে পুজো শুরু হয়েছে ।
বিশাল এক বটবৃক্ষ । মোটা মোটা ঝুড়ি নেমেছে চারিদিকে , বাঁধানো চাতাল । সেখানেই এক গুহা ।মাথা নিচু করে প্রবেশ করলাম ।এটিই সেই মহামুনির সিদ্ধাসন ।একটি মানুষই সেখানে ঢুকতে পারবে ।
আশ্রমের গেটের ডানদিকে অপূর্ব এক কালীমন্দির । সিদ্ধ মাতৃ সাধক অনাথনাথ ব্রম্ভচারীর প্রতিষ্ঠিত মা ভবতারিণী ,রাজরাজেশ্বরী মূর্তি । মহারাজ যে কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন খেয়াল করিনি ।আমার মোবাইলে ধরে রাখছি সব ,মায়ের এই অনিন্দ্য মূর্তিটিও ।
দেখেছেন কেমন মায়ের জ্যোতি — তাকিয়ে দেখি সত্যি অন্ধকারের মধ্যে এক জ্যোতি ফুটে উঠেছে ছবিতে । সত্যি ! অপরুপ !
বাইরে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় ,একটি পরিত্যক্ত কুয়ো ,চারিদিকে বিস্তৃত মাঠ । পাশেই গলি দিয়ে চলে গেছে শ্মশানের পথ ।
সকালের মুড়ি ,ঘুগনি খাওয়া হয়েছে ভেতরের উঠোনে । পাশে রান্নাঘর আর ভৈরব মন্দির । মহারাজের পুজো পাঠ ,যজ্ঞ সব শেষ হল ।
রাখী পূর্ণিমা আর শ্রাবণ মাসে পুরাতন বক্রেশ্বরে প্রতিষ্ঠিত শিব মন্দিরে উৎসব হয় ।
উঠোনে খেলা করছিল গ্রামের ছেলেমেয়েরা । এই শীতে ওদের গায়ে গরম জামা নেই । কাছেই ওদের গ্রাম দেবগঞ্জ । ঝাড়খণ্ড লাগোয়া এই প্রত্যন্ত গ্রামে ওদের কথা কেউ ভাবে কি না জানা নেই । গল্প করে জানলাম ওরা স্কুলে যায় ।সেখানে খেতে পায় ।
দুপুরে মাটিতে বসে ভোগ খাওয়া হল । তারপর আবার সেই পথ ধরে ফেরা । তখন সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়ছে ।
মন যেন রয়ে গেল সেই শান্ত নির্জন তপোবনে । ধূ ধূ মাঠ উদাস বিবাগী ,শীতের রুক্ষ হাওয়া বয়ে চলেছে শনশন ….শনশন …
আসার ঠিকানা — হাওড়া থেকে হুল এক্সপ্রেসে দুবরাজপুর স্টেশনে নেমে গাড়িতে আসতে হবে ।