শাংগ্রীলা – একটি ম্যাজিক্যাল উপত্যকা – শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়

শাংগ্রীলা – একটি ম্যাজিক্যাল উপত্যকা – শেষ পর্ব
(পূর্বপ্রকাশিতের পর)

শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়

শাংগ্রীলার কোলে অলৌকিক রহস্যময় জ্ঞানগঞ্জ- টাইম চেম্বার ?

আগের পর্বে আমি আলোকপাত করেছিলুম শাংগ্রীলা ঘাঁটির ওপর । এবার শুরু করতে যাচ্ছি এরই কোলে অবস্থানরত ৯টি মহাসিদ্ধ মঠের একটিকে নিয়ে- যার নাম ‘জ্ঞানগঞ্জ’। ভারতের মাত্র কয়েকটি স্থানে এর শাখা আশ্রম আছে। এগুলিকে সঙ্গে নিয়ে তিব্বতের জ্ঞানগঞ্জই মূল কেন্দ্র। প্রথম জ্ঞানগঞ্জ ব্যাবহারিক, বহু সিদ্ধ মহাযোগীদের আবাস এটি।এর পঞ্চপদার্থ [ মাটি ,জল,অগ্নি,বায়ু,আকাশ] এঁদের তেজ দ্বারা প্রকটিত। যে আলোকচিত্রগুলি পাওয়া যায়, সেগুলি খুব সম্ভবত: এই প্রথম জ্ঞানগঞ্জের।কিন্তু আমি আলোচনা করতে চলেছি দ্বিতীয় জ্ঞানগঞ্জকে নিয়ে, যেটি পারমার্থিক।যোগের চরম শিখরে যাঁরা আছেন, কেবল ত্যঁদেরই দ্বারা অনুভবযোগ্য।শ্রী তৈলঙ্গস্বামী, রামদাস, বাবা লোকনাথ, রাম ঠাকুর,শ্যামাচরণ লাহিড়ী, কালিপদ গুহরায় – এঁরা সকলেই এই জ্ঞানগঞ্জ দর্শন করেছিলেন। ড: গোপীনাথ কবিরাজ প্রথম এই মঠের কথা লিখে সাধারণের গোচরে আনেন।

৩-ডি এবং ৪-ডির মাঝে সংবদ্ধ অপূর্ব এর অবস্থান, ভূমির থেকে বিযুক্ত, অথচ অদৃশ্য ভিত্তিভূমি আছে।এখানে যাঁরা থাকেন, কয়েকশো থেকে কয়েক হাজার বছরও আয়ু নিয়ে এঁরা বেঁচে আছেন। আহার নিদ্রার প্রয়োজন হয়না। শরীরকে ভারশূন্য [অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি] করে আকাশচারী হন, কখনও বা পরমাণুর আকারে লোকে লোকান্তরে ভেসে বেড়ান।শরীরের ঘুমিয়ে থাকা ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক ফোর্সকে যোগপ্রক্রিয়ায় আচার অভ্যাসে উজ্জীবিত করে নাকি অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা অর্জন সম্ভব। পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা এবং শারীরবিদ্যা- এই ত্রিশক্তির চূড়ান্ত সংহত প্রকাশই যোগশক্তি, যা নাকি অলৌকিক ইচ্ছাশক্তিরও জন্ম দেয়। তাই বলা হয়, যোগবজ্ঞান হল ফলিত [অ্যাপ্লায়েড] বিজ্ঞানের চূড়ান্ত ফল। পুরাণের অতিজাগতিক দেবতাদের এই বৈশিষ্ট্যগুলির কথা আমরা চিরকাল পড়ে এসেছি।
পারমার্থিক জ্ঞানগঞ্জ যোগসাধনায় লব্ধ প্রবল ইচ্ছাশক্তি দিয়েই তৈরি।এখানে বসবাসকারী যোগীদের রক্তের রংও জিনগতভাবে পরিবর্তিত, ঘাসের মত সবুজ রং। [ এ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল রসওয়েলস্-এর ঘটনা। ১৯৪৭ সালের জুনমাসে নিউমেক্সিকোতে একটা ইউএফও[UFO] ভেঙে পড়ে।৬জন মৃত এলিয়েনকে তুলে নিয়ে গিয়ে গোপনে নানা পরীক্ষা করা হয়। তাদের রক্তের রংও নাকি ছিল সবুজ। এ প্রসঙ্গে আমেরিকা আজও মুখ খোলেনি।] প্রায় ১৬ হাজার ফুটেরও বেশী উচ্চতায় কুয়াশায় ঢাকা জনহীন বৃক্ষহীন তুষারময় এই স্থানে কিন্তু জ্ঞানগঞ্জ আলোকময়, ঊষ্ণ।চাক্ষুষ করে আসা যোগীরা এক অশ্রুতপূর্ব গঠনশৈলীর
বর্ণনা করেন। সম্পূর্ণ আবাসনটি একটা ঝিলমিল করা কম্পিত তাপতরঙ্গ মাত্র, মাকড়সার জালের মত, যাকে চোখে দেখা যায়, কিন্তু ধরতে গেলে বোকা বনতে হয়। দিগন্ত বিস্তৃত সেই জালঘরের অভ্যন্তরে ঘুরে বেড়ায় অজস্র রঙের প্রকাশতরঙ্গ আর আলোকবিন্দু [Electro-magnetic effect ?] চারদিকে মনে হয় আয়না বসানো আছে, তাতে যুগপৎ দেখা যায় ২১ কিমি জ্ঞানগঞ্জের সবটাই। সেখানে নিরন্তর দুধ-সাদা উজ্জ্বল ঊষা,অথচ উৎস সাধারণের অগোচর [আলো, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?]। পাখির কূজন, সরোবরে হংসমিথুনদের ভেসে বেড়ানো, পত্রপুষ্পে ভরা চির বসন্ত, চারিদিকে ধ্যানমুদ্রায় আসীন সমাহিত মহাযোগীরা ।[এই সব বর্ণনা আমাকে মনে করিয়ে দেয় সংস্কৃত সাহিত্যে বর্ণিত সেই সব পর্বতীয় মুনিজনপদগুলির কথা, সেগুলিও ছিল তপোপ্রভাবিত]। জ্ঞানগঞ্জের সাধকেরা মৃত্যুহীন,চিরযুবা,পার্থিব তপোদেহধারী।প্রয়োজনে দেহমুক্ত হয়ে চলে যান লোকান্তরে,উচিত গর্ভে পরহিতার্থে জন্ম নেন, কখনও মৃত শরীরে প্রবেশ করেন
আরো উচ্চতর লক্ষ্যে।এঁরা কথা বলেননা, বার্তালাপ করেন মন:শক্তি দিয়ে।[সম্প্রতি প্রকাশিত একটি উদ্ভিদবিজ্ঞানের গবেষণার দিকে পাঠকদের নিয়ে যাই। গবেষকরা জানাচ্ছেন, গাছেরা নাকি অতীন্দ্রিয় ক্ষমতায় পরস্পর বা্র্তা বিনিময় করে। কোনও কোনও মারণ পোকা একটা গাছে লাগলে অন্যেরা সেই খবর পায় এবং এমন একটি বিশেষ রসক্ষরণ করতে শুরু করে, যে পোকাগুলি সেখানে আক্রমণ করে ,মারা পড়ে। পৌরাণিক দেবতারাও এই অতিজাগতিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।আমরা আজও বলি, ঠাকুর মনের কথা টের পান। এগুলো কি শুধুই কথার কথা? দানিকেন সাহেবতো এঁদের বলেন, দেবতা নয়,এঁরা ছিলেন প্রাচীন অপার্থিব নভশ্চর,বহির্জাগতিক এলিয়েন। এলিয়েন দ্বারা অপহৃত মানুষরাও বলেন, ওরা তাঁদের সঙ্গে নাকি মাইন্ড দিয়ে বার্তালাপ করেছেন]।এই দিব্য মণ্ডলের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নাকি চলে সুদূর নীহারিকায় থাকা কোনও অতীন্দ্রিয় লোকের নির্দেশে। নানা দৈব দুর্বিপাক থেকে জ্ঞানগঞ্জ নাকি পৃথিবীকে রক্ষা করে চলে কারণ,যোগীরা ভূমির সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করেই চলেন।নেটেও এই কথার সমর্থন পেয়েছি।
এখানকার বিজ্ঞানচর্চার কথাও না বললে নয়। ১ম টি যোগের তাত্বিক বিভাগ, ২য় টি এর প্রয়োগ বিভাগ।এটির ১৬টি ভাগ আছে। সূর্য বিজ্ঞান, নক্ষত্র বিজ্ঞান, চন্দ্রবিজ্ঞান, কালবিজ্ঞান, বায়ুবিজ্ঞান,ক্ষণবিজ্ঞান,শব্দবিজ্ঞান,সংগীতবিজ্ঞান –এমনি আরো কত !বিশাল বিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মত পাথরের অট্টালিকায় এগুলির পঠন-পাঠন হয়। বিশ্বের সৃষ্টি স্থিতি লয়ের নিয়ন্ত্রণ করে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছেন এখানকার মহাযোগীরা [ মহাপ্লাবনের সময় নোয়ার জাহাজ বা মৎস্য অবতার-যারা কিছু মানুষকে বাঁচিয়ে ছিল, তারা কি জ্ঞানগঞ্জের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল?নবীন গবেষকরা বলেন, মহাপ্লাবনও নাকি পূর্বপরিকল্পিত ছিল ]।সৃষ্টি রহস্যকে সংরক্ষিত করার উদ্দেশ্যেই নাকি পারমার্থিক এই স্থান তৈরি হয়।

অমরত্বের এই দেশে কোন মণিরত্ন ভরা আছে? উপনিষদে নচিকেতাকে যমরাজ আত্মার স্বরূপ আর অমরত্বের অনেক কথা বললেন বটে, কিন্তু সযত্নে
তার প্রয়োগের কথা এড়িয়ে গেলেন।কী ছিল তার প্রয়োগ-বিধি? কোথায় ছিল তার হদিস? সে কি পাতালে নাগরাজ্যের কবলে ছিল? তাই কি সমুদ্র মন্থন? মন্থনে উঠে আসা অমৃতকুম্ভই কি সেই জ্ঞানভান্ডার? তথাকথিত দেবতারা পৃথিবীবাসীকে অমৃতের ভাগ দিলেন না কেন? সে কি অপপ্রয়োগের ভয়ে?প্রয়োগবিধির সেই পুঁথিকে তাঁরা কোথায় সুরক্ষিত করলেন?লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা এই জ্ঞানগঞ্জে? অরুণাচলের ওপারে থাকা অতি প্রাচীন সভ্যতার ধারক বিদেশী রাষ্ট্রটির কাছে এই খবর কি প্রাচীনকাল থেকেই আছ? তাই কি তারা নানা আছিলায় ভারত আক্রমণ করে আর বিধিবহির্ভূত পথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে নিজেদের মানচিত্রে ঢোকায়?কিন্তু আজও তারা ৪র্থ আয়ামে অদৃশ্য এই জায়গাকে খুঁজে পায়নি।একটি তথ্য বলছে, একবার এই অধিকার-অভিযানে আসার পথে বায়ুসুরঙ্গে ঢুকে তাদের হাজার হাজার সৈন্য নাকি চিরতরে অদৃশ্য হয়েছে। তবু ওই রাষ্ট্র আজও আছে সেই অমৃতকুম্ভের সন্ধানে, যা নাকি মানুষকে অমরত্ব দেয়।

এক সিদ্ধযোগী ওখানে সশরীরে গিয়ে ৮দিন ছিলেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হয় এক উচ্চকোটীর যোগীর। সিদ্ধ যোগী তাঁকে জিগ্যেস করেছিলেন, অপার্থিব এই স্থান যদি কোনওদিন সত্যিই বিপন্ন হয়, তাহলে কী হবে? তাঁর জবাব ছিল, সে সুযোগ কেউ পাবেনা, তার আগেই এটি উড়ে অন্য নক্ষত্রমণ্ডলে সুরক্ষিত জায়গায় গিয়ে স্থিত হবে।
তাঁর উত্তরটিতে আমি যুগপৎ চমৎকৃত এবং চমকিতও বটে।কারণটা বলি।দার্শনিক প্লেটোর ‘ডায়লগ’-খ্যাত অ্যাটলান্টিস সভ্যতা মহাপ্লাবনে সাগরে ডুবে যায়, সাধারণে
এ কথাই জানে। কিন্তু নবীন পুরাতাত্বিক ও অন্তরীক্ষ-গবেষক জর্জিও এ সুকালোস [উচ্চারণ সঠিক নাও হতে পারে] অতি সম্প্রতি বললেন অন্য কথা। প্রামান্য সহ তিনি বলছেন, এটি ডুবে যায়নি, আকাশে উড়ে গেছল। তিনি বিশ্বাস করেন, গোটা দ্বীপটিই ছিল টাইম মেশিনে সংস্থাপিত একটা জেনারেশন শিপ, যেটি বিপদ আসতেই সুরক্ষিত লোকে চলে গেছে। পাঠকরা এও নিশ্চয়ই জানেন, এটিও দেবতাদের দ্বারা নির্মিত মহাদেশ ছিল, নির্মাতা ছিলেন দেবতা পোসাইডন- প্লেটোর দেয়া তথ্য অনুসারে [দেবতারা এলিয়েন কিনা সে অন্য প্রসঙ্গ]। সাম্প্রতিক দ্বীপ- গবেষকরা বলেন, এমন অনেক দ্বীপ আছে, যেগুলো স্যাটেলাইটে ধরা পড়ছে, অথচ কাছে গেলে দেখা যাচ্ছে নেই, অদৃশ্য! আমার প্রশ্ন, তাহলে জ্ঞানগঞ্জও কি এরকমই একটি টাইম চেম্বার, যেটি আপৎকালে উড়ে যাবে? এটি একটি টাইম মেশিন বলেই কি পার্থিব বিজ্ঞানের অজানা কোনও যান্ত্রিক নিয়মে নির্দিষ্ট সময়ান্তরে ২১কিমি থেকে ১কিমির মধ্যে সংকুচিত আর প্রসারিত হতে থাকে!এই কি সেই অমৃতসদন, যা লোভী মানুষের অনধিকারেই রয়ে যাবে!!!
সমাপ্ত
_____

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *