## অশান্ত কার্গিল নিয়ে কিছু কথা : কলমে : মালা মুখোপাধ্যায়
## অশান্ত কার্গিল নিয়ে কিছু কথা :
কলমে : মালা মুখোপাধ্যায়।
আমার লেখা অশান্ত কার্গিল উপন্যাসটি গবেষণা মূলক লেখা। গতবছর প্রকাশিত হয় আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায়। অশান্ত কার্গিল উপন্যাসটি পড়ে পাঠ প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন,বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ হিমাদ্রী সাহা মহাশয়। আমি নিচে ওঁনার লেখটি দিলাম। এই পাঠ প্রতিক্রিয়া পড়ে আশা করি অনেকেই বুঝতে পারবেন, বইটি সংগ্রহ করে পড়ার মতো।
“লেখিকা মালা মুখোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস ” অশান্ত কার্গিল” — আমার পর্যালোচনা
এই বছর কোলকাতা পুস্তক মেলায় একটি উপন্যাস আমাকে আকর্ষণ করে। লেখিকা : মালা মুখোপাধ্যায় ও উপন্যাসের নাম : অশান্ত কার্গিল। এমন একটা বিষয় নিয়ে লেখিকা এই উপন্যাসটি লিখেছেন তা বোধ করি সব ধরনের পাঠক-পাঠিকাকেই আকর্ষণ করবে। আসলে কার্গিল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই লেখার সাথে দেশভাগের এক করুণ ইতিহাস জড়িয়ে আছে । সব সময় এই ইতিহাস সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে না। তাই এই লেখা নিছক উপন্যাস নয় — ইতিহাসের নানা অজানা তথ্যের সম্ভারে সমৃদ্ধ এই উপন্যাস তাই একটি সময়কে সত্যনিষ্ঠ করে তুলে ধরার এক ঐকান্তিক গবেষণাধর্মী প্রয়াস। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় বিষয়বস্তু আকর্ষণ করলেও কোনো কোনো উপন্যাস পাঠকের আকর্ষণ হারায় তার পরিবেশনার প্রাঞ্জলতার অভাবে। এই ক্ষেত্রে এই উপন্যাসের লেখিকা একশো শতাংশ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণা। ইতিহাসের গম্ভীর তথ্যকে তিনি তুলে ধরেছেন একটি গ্রামে চায়ের দোকানে ( গণশার চায়ের দোকানে) বিভিন্ন চরিত্রের আলাপচারিতায়। সেই আডডায় যেমন পাওয়া যায় গ্রামের মেজাজ তেমনি উঠে আসে কার্গিল যুদ্ধ, কাশ্মীর, এবং সীমান্তের ভৌগোলিক চিত্র। আসলে যথার্থই বলেছেন লেখিকা যে যুদ্ধক্ষেত্রেই শুধু যুদ্ধ হয় না, যুদ্ধের উদ্বেগে আরেক যুদ্ধ চলে সেই সব বাড়িতে যেখান থেকে ঘরের ছেলেরা যায় দেশের জন্য লড়তে। তাঁরা দেশের গর্ব । তাই সেই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে এক একটা এলাকায় মানুষের মনে। তাই যখন কার্গিল সীমান্তে কর্তব্যরত সেনা প্রশান্তর ছিন্নভিন্ন দেহ কফিনে আসে গোটা গ্রামটা যেন ডুকরে কেঁদে ওঠে। দেশের প্রতি মমত্ববোধ ও গভীর ভালোবাসা যেন গ্রামবাসীর রক্তে একাত্ম হয়ে যায় । তাই যুদ্ধের সময় ভারতীয়় সেনাবাহিনীর অগ্রগতি তাদের মনে দেশাত্মবোধের চেতনাকে উসকে দেয়।
এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য হল ইতিহাস। তাই যথার্থই উঠে এসেছে ৭১৯ খ্রীষ্টাব্দে কাশ্মীরের বুকে হিন্দু সম্রাট ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার বীরকথা এবং তার মৃত্যু পরবর্তী সময়ে মুসলিম শাসকদের আধিপত্য। কাশ্মীর সমস্যার সাথে দেশভাগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। লেখিকা এখানে তাঁর চরিত্রের মুখে বলিয়েছেন যে দেশভাগ আসলে ধর্মের ভিত্তিতে একটা দেশকে টুকরো করা। দ্বিজাতি তত্ত্ব। তার ফলে ভিটে মাটি ছেড়ে চলে আসতে হয় অগণিত মানুষকে আজকের ভারতবর্ষে। এ যেন এক দহন যন্ত্রনা। এক রক্তক্ষরণ। গ্রামের মানুষের খুব সহজ কথা যেটা লেখিকা এই উপন্যাসে তাঁর নানা চরিত্রের মুখে বলিয়েছেন যে এখানেও তো তাঁরা দিব্যি হিন্দু মুসলমান একসাথে বাস করছেন কয়েক পুরুষ ধরে কোনো ঝামেলা বা দাঙ্গা ছাড়াই পারস্পরিক সৌহার্দ্যে । এ যেন প্রকারান্তরে ক্ষমতার হস্তান্তর। এইসব কথোপকথনে গণশার চায়ের দোকানে আলোচনা খুব বেদনাময় হয়ে ওঠে যেখানে থাকেন হলধর মাষ্টার, সৈয়দ স্যার, দিবাকর স্যার, যুদ্ধ ফেরত শিশির, আনন্দ ,আরো অনেকে। আর গণশা তো আছেই।
হিন্দু মুসলমানের এই তৈরি করা বিভাজনের আঁচ এসে পড়ে কাশ্মীরেও। স্বাধীন কাশ্মীর — ভারতের মধ্যে থেকেও আলাদা সুবিধা ভোগের ইতিহাস। এ এক রাজনীতি ও তোষনের খেলা। তাই এই উপন্যাসে অবধারিতভাবে অনেক অপ্রিয় প্রসঙ্গ এসেছে। লেখিকা এক জায়গায় তাঁর এক চরিত্রের মুখে এও বলিয়েছেন যে কার্গিল যুদ্ধ আমাদের তৈরি। যদিও দেশের মানুষ এই যুদ্ধে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হন তবুও এই যুদ্ধের কি প্রয়োজন ছিল যদি আমাদের রাজনীতিকরা স্বার্থসিদ্ধির পথে না গিয়ে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিতেন। ওনার উপন্যাসের মূল সুর বোধহয় এটাই যে হিন্দু মুসলমানের বিভাজনের ফলেই এইসব সমস্যা। দেশভাগ কি খুব জরুরী ছিল? এত যে জীবনের বলিদান, তার উদ্দেশ্য কি এই ছিল?
আমি লেখিকাকে আমার কৃতজ্ঞতা এই কারণে জানাবো যে উনি আবির্ভাবেই এক বিতর্কিত বিষয়ে উপন্যাস লেখার সাহস দেখিয়েছেন এবং তা গুরুগম্ভীরভাবে নয়। মূলতঃ গ্রামের এক চায়ের দোকানের সহজ সরল আডডায় বিভিন্ন চরিত্রের আলাপচারিতায়।
ওনার এই গবেষনাধর্মী উপন্যাস, ” অশান্ত কার্গিল” যদি মতের অনৈক্যও সৃষ্টি করে কোথাও, সেটা বোধ করি ইতিহাসধর্মী সাহিত্যের পক্ষে আশার আলো দেখাবে। আশা রাখি, আমরা আসন্ন নতুন বাংলা বর্ষে শ্রীমতি মালা মুখোপাধ্যায়ের হাত দিয়ে অন্য ধরনের বৈচিত্র্যমূলক এমনই উৎকৃষ্ট মানের লেখা পাবো।
অধ্যাপক ডঃ হিমাদ্রী সাহা