শিরনাম: উজ্জ্বল চোখের সেই গ্রাম্য বালক কলমে : শুভা গাঙ্গুলি
শিরনাম:উজ্জ্বল চোখের সেই গ্রাম্য বালক
কলমে : শুভা গাঙ্গুলি
ঈশ্বর কাকে কখন প্রতিভা নামক দৈব গুণের অধিকারী করে পাঠাবেন তা মানুষ ঘুণাক্ষরেও অনুমান করতে সমর্থ হয় না । দারিদ্রতা দীনতার মধ্যেও তার গুণ শিশুবয়সেও পরিলক্ষিত হয়, আমরা যাদের child prodigy বলে থাকি,
বাঁকুড়া থেকে ১৯২৫ সালে একজন গুণী ব্যক্তির হাত ধরে স্থাবর জঙ্গম পার হয়ে এক হতদরিদ্র প্রামাণিকের সন্তান বোলপুরে আসছেন, কারণ সেই বিচক্ষণ সাহিত্যিক ঠিক চিনতে পেরেছেন এই কয়লার মধ্যে হীরা আছে,
যদিও আমরা জানি কয়লায় হীরা থাকে না তবে রসায়ন বলে কয়লা আর হীরা একই গোত্রের তবে আকাশপাতাল তফাত চরিত্রের।
সেই সময় রাস্তাঘাট সহজ ছিলো না, তাই বাঁকুড়া থেকে প্রথমে বাসে দামোদরের চুণপোডা ঘাট ,সেখান থেকে নৌকায় নদী পেরিয়ে, হেঁটেছেন দুর্গাপুর স্টেশন জংশনে ট্রেণ পাল্টে লুপ লাইনে বোলপুর পৌঁছলো
বছর আঠারো উনিশের একটি দরিদ্র
নাপিতের সন্তান, যার শিক্ষা গ্রামের স্কুলের ম্যাট্রিক পর্যন্ত ।
গ্রাম্য চেহারার খদ্দর পরিহিত বালক এসে দাঁড়ালো বিশ্ববরেণ্য কবি, শিল্পীদের সামনে,কলাভবনের শিক্ষক নন্দলাল বসু ছবি আঁকা দেখলেন,
বললেন, ‘সবই তো শিখে এসেছো’
কার হাত ধরে ঈশ্বর এই বালককে তার উপযুক্ত জায়গায় এনে ফেললেন ,
তাঁর নাম রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়
প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক, এবং প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক ।
একটা টিনের তোরঙ্গ, কিছু জামাকাপড় , পেন্সিল স্কেচ,কিছু ওয়াটার কালার নিয়ে প্রবেশ যার, আপন প্রতিভাতে একদিন পদ্মভূষণ ,দেশিকোত্তম উপাধিতে ভূষিত হবেন এই খদ্দর পরিহিত বালক যাকে সহপাঠীরা খদ্দর বন্ধু বলে ডাকতো।
আমরা যদি আবার একটু কল্পনায় পিছনে যাই, তা হলে দেখবো আর একজন বালক , যাকে সবাই ডাকে যশরের কই বলে, কারণ ক্ষীণ দেহ খর্বকায় মুণ্ড তাহে ভারী, যশোরের কই যেন নরমুর্তিধারী।
তখন কি কেউ জানতো,যে একজন যুগপুরুষ তার বাবার হাত ধরে কলকাতায় পদার্পণ করলেন,
যিনি সমাজসংস্কারক ই শুধু নন ,’একজন বিদ্যার আর দয়ার সাগর যাঁর হৃদয় একজন বাঙালী মায়ের মতো, যিনি তাঁর সময়ের অনেক আগে জন্মেছিলেন।
দেশে থাকার সময় তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি আঁকতেন,
সেই ছবির perfection মুগ্ধ করে trained artist নন্দলাল বসুকে।
তাঁর পদবী বৈজ নিয়েও সহপাঠীদের হাসাহাসি,ক্ষিতিমোহন সেন বোঝালেন বৈদ্য থেকে সরল মানুষের জীহ্বায় ভেঙেচুরে হয়েছে বৈজ,
শহুরে সুশিক্ষিত মানুষদের , ভাষা তাঁর মনঃপুত হতো না , তিনি অমুকের আবিষ্কার ইত্যাদি শুনতে পছন্দ করতেন না,তাই নিজেকে ভুঁইফোড় মনে করতেন।
১৯২০ সালের জুন মাসে রবীন্দ্রনাথ অক্সফোর্ডে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের কাজে,সেখানে মন্দিরের ভাস্কর্য নিয়ে বক্তৃতা দেন স্টেলা ক্রেমরিশ, তাঁকে শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রণ জানান কবিগুরু স্বয়ং, এসেছিলেন তিনি শান্তিনিকেতন তখন রামকিঙ্করের কাজ প্রসিদ্ধি লাভ করছে , তিনি বললেন “একটা পাহাড় ধরো কিঙ্কর, একটা পাহাড় ধরো”
অর্থ বুঝলেন দুজনই যিনি বললেন আ র যাকে বললেন,
১৯৫৪ সালে কুলু যাওয়ার পথে, বৈজনাথের পাহাড় কেটে পাথর আনলেন,খুব সহজ ছিলো না সেই কাজ,বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইঞ্জনিয়ার দের সাহায্য নিয়ে দিল্লিতে এনেছিলেন সেই পাথর,কারণ দিল্লীর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গেট আলো করে দাঁড়াবে সেই যক্ষমূর্তি, যক্ষ আর যক্ষী, আর তারা নাকি রামকিঙ্করের জীবনে বিশেষ কোনো রমনীর মুখাবয়ব।
১৯৬৭ এ শেষ হলো যক্ষী , চিঠি লিখলেন তাঁর শেষজীবনের সঙ্গী রাধারাণীকে, “তোমার মুখের আদলে গডেছি যক্ষী, অনেক টাকা পেলাম, ভুবনডাঙায় তোমার জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা হবেই এবার, “
কেটে গেছে আরো কিছু সময় , গড়েছেন যক্ষ, নিজের আদলে, দিল্লীর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দরজায় তারা আজো প্রহরায়,শুধু কালের নিয়মে চলে গিয়েছেন তাদের শ্রস্টা, আর সময় মুছে নিয়ে গেছে আবেগ, প্রেম ভালোবাসা।
রামকিঙ্কর বলেছেন ,” প্রোট্রেট আঁকতে গেলে মুখটাকে ভাল করে স্টাডি করা দরকার,মুখের অ্যানাটোম্র নকল নয়,character টা ফুটিয়ে তোলাই উদ্দেশ্য”
তাই তো তাঁর তৈরী ,
রবীন্দ্রনাথের মূর্তি সমাদর পায় নি, যদিও খোদ রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করেছিলেন, বলেছিলেন তুইই আমাকে ঠিক চিনেছিস।
রামকিঙ্করের মতে রবীন্দ্র নাথের শরীরে নাকটাই ছিলো নাকি ওনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট।
আমরা অনেকেই জানি স্বাধীনতার পর শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোডের
নেতাজী মূর্তির জন্য plaster of Paris এর একটা ছোটো মূর্তি পাঠান তিনি,
ঘোড়ায় সওয়ার নেতাজী, মুশকিল হলো সওয়ারী আর ঘোড়া একাকার,
ঘোড়া আর নেতাজী দুজনেই যে তোদের প্রতীক,
সরকারি কর্তারা তাঁর মূর্তি ফেরত দিলেন,
সত্তর দশকের ওই সময়টায় শিল্পজ্ঞানহীন, বেরসিক বঙ্গসমাজকে
হাড়ে হাড়ে চিনেছেন তিনি,
তাই তাঁর উক্তি
“মূর্তি ওরা বুঝলো না”
বার বার এমন হয়েছে কবিগুরুর কথার জবাবে বলেছেন আমার স্বপ্নে এমনই আসে আমি তাই করি,
স্বপ্নটাকে ধরে থাকিস, এটাই জবাব ,
রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন উদাত্ত্ব কণ্ঠে শ্রুতিমধুব হতো কিনা জানা নেই , কারণ সহপাঠিরা বলেছিলো সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে গাইতে,
কিন্তু তাতে ভাঁটা পড়েনি তাঁর উত্সাহে,তাঁর প্রিয় গান,
“আজ তারায় তারায়
দীপ্তশিখার অগ্নি জ্বলে
নিদ্রাবিহীন গগনতলে”
তাঁর গলায় আন্তরিকতা ছিলো ,তাঁর চলাফেরা,কথা বলা,প্রতিটি ভঙ্গিতে তাঁর যে লাবণ্য ঝরে পড়তো,সেটাই প্রস্ফুট্ত হতো তাঁর হস্তশিল্পেও।
মৃত্যুর দশ বছর আগে পেয়েছিলেন
‘পদ্মভূষণ’, ১৯৭৫ এ ঋত্বিক ঘটক তাঁকে নিয়ে করেন তথ্যচিত্র, সাহিত্যিক সমরেশ বসু লিখেছেন তাঁকে নিয়ে ‘দেখি নাই ফিরে’
রামকিঙ্করের শিল্পকর্মের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে আদিবাসী জীবন, সাঁওতাল পরিবার, মিলের ডাক সবই , তবে নিশ্চয় আছে বুদ্ধ সুজাতা ইত্যাদি ,
অতিরিক্ত মদ্যপান তাঁর কাজে বিঘ্ন ঘটায় নি, হয়তো মনঃসংযোগের জন্য খেতেন পরে তা অভ্যাসে দাঁড়ায়,শোনা যায় ওনার সাথে দেখা করতে হলে সঙ্গে সোমরস নিয়ে গেলে খুশি হতেন,একবার বৃদ্ধ বয়সে কোনো দৈনিক সংবাদপত্রের এক সংবাদ সংগ্রাহক পৌঁছলেন তাঁর ভুবন ডাঙার বাডীতে, ভিতর থেক বের হয়ে এলেন তাঁর সঙ্গিনী , কাতর অনুরোধ আপনারা কেন এসব আনেন বলুন তো, উনি তো শরীর খারাপ করেন খেয়ে, এরপর এলেন স্বয়ং শিল্পী বললেন, বাহ্ বেশ করেছো, তবে আমার রিস্কা আসবে এক্ষুনি, সাপের মাংস নিয়ে ,খুব ভালো লাগে ওনার, আশ্চর্য় মানুষের অদ্ভূত খেয়াল।
বোহেমিয়ান জীবন যাত্রা আদিবাসী রমণীদের সঙ্গে চলে যেতেন অজানা ঠিকানায়,অনেক বদনাম অনেক অপমান কিছুই বদলাতে পারেনি তাঁর জীবনযাত্রাকে।
প্রেমে পড়েছেন অনেকবার ,প্রত্যেকেই অমর হয়েছে তাঁর ভস্কর্যে, মণিপুরী ছাত্রী বিনোদিনী,তার মুখের আদলে তৈরী সুজাতা,ছাত্র জয়া আপ্পাস্বামী, এরা হয়ে গেছে চিরকাল তাঁর সৃষ্টিতে।
রাধারাণী একজন আদিবাসী রমণী জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সাথে ছিলেন , বিবাহিতের সম্মানে নয়, ভালোবাসার বন্ধনে,
মীরাদেবীর বাড়ী কাজে লেগেছিলেন পারিবারিক অশান্তিতে,সেখানে পরিচিত হন বড় বড় মানুষের সাথে,বার বার তাকে নিজের কাছে রাখবার জন্য অনুরোধ জানান রামকিঙ্কর অবশেষে দুজনের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে ওকে রামকিঙ্করের হাতে তুলে দেন মীরাদেবী,
তারপর সেইদিন থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সাথে থেকেছেন দুজনে দুজনকে বিবাহ করেননি ঠিকই তবে তিনি তাঁর মডেল দের অবহেলা করেন নি, genius এর স্পর্শে তারা glorified হয়েছেন,আর ভাস্কর তাঁর শিল্পে তাদের অক্ষয় অমর করেছেন।
‘দেশিকোত্তম ‘ উপাধিতে শিল্পী কে সম্বর্ধনা দেওয়া হবে, বায়না ধরলেন শিল্পী যে মঞ্চে উপাচার্য থাকবেন, সেখানে রাধারাণী কেও সমান সম্মানে বসতে দিতে হবে, তাঁরা মানতে বাধ্য হয়েছিলেন, কারণ শিল্পীর ক্ষমতা এতটাই ছিলো,
বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন নি কখনও তথাকথিক marriage institution এ বিশ্বাসী ছিলেন না, তাঁর চিন্তা ভাবনায় ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ,
উদাত্তকণ্ঠে গান ধরতেন
“ও আমার চাঁদের আলো”
শিরদাড়া টান টান করে চলতেন তাঁর কাজের সময়ও সেভাবেই বসে থাকতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।সেই বলিষ্ঠতা ,সেই তীক্ষ্ণতা, যা তাঁর চলাফেরা তাঁর কথাবার্তায় ঝরে পডতো, সেই দৃঢ়তাই ঝরে পডতো তাঁর শিল্পকর্মে তাঁর ভাস্কর্যে।
দিল্লীর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দরজায় আজও প্রহরায় ২১ ফুটের যক্ষী যা তাঁর রাধারাণীর আদলে সৃষ্টি আর এক যক্ষ যা তাঁর নিজের অবয়ব।