মৃত্যুচেতনা প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাব্যে ……….. গীতশ্রী সিনহা

‘নগরের ছায়া গেছে নেমে,
নেমে গেছে অরণ্যে আরেক…
সে অরণ্যে নব – মৃত্যু মোরা সৃজিয়াছি। ‘

মৃত্যুচেতনা প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাব্যে
…………………………………………

গীতশ্রী সিনহা

‘ নব – মৃত্যু মোরা সৃজিয়াছি ‘ কথা টি এখানে গভীর অর্থবহ। এই কথা কটি দিয়ে কবি প্রেমেন্দ্র স্পষ্ট করেছেন মানবিকসত্তার মৃত্যুর কথা। নিজেরই সৃষ্ট নগরে নিজ অন্তরাত্মার মৃত্যু আর কি। মৃত্যু ঘটেছে আমাদের আত্মিক চেতনারও। কবি প্রেমেন্দ্রের চোখে এ সত্যটি এডায়নি, তিনি সুন্দর ভাবে এই ক’টি পংক্তিতে তুলে ধরেছেন। বাস্তববাদী কবি হওয়ার জন্যই মানবজীবনের প্রতি তাঁর অগাধ আস্থা ছিল। এ কারণে জীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার সঙ্গে মৃত্যুকে দেখেছেন নানা বর্ণে, স্বাদে, রঙের নানান বৈচিত্র‍্যে। কবি প্রেমেন্দ্রের মৃত্যুচেতনার বহুমুখীনতা লক্ষ্য করা যায় তাঁর কাব্যে। কিছু দৃষ্টান্ত রাখছি…
১) শুধু এ সেতুর হেতু জানি না কো
উতরিয়ে ভয়ে মরি। ( ‘সেতু ‘, ” প্রথমা “)
২)বদ্ধজলে মৃত্যুর জীবাণু বংশ বিস্তার ক’রছিল,
আজ প্রাণের বিপুল বেগে সাফ হয়ে গেল
বনেদি জঞ্জাল, সনাতন ধাপ্পাবাজি
( ‘ রাস্তা ‘, ” ঐ “)
৩) মৃত্যু প্রতীক্ষারত সৈনিকের বুকে শুধু ,
স্তব্ধতা গভীর,
অলস মধ্যাহ্ন – স্বপ্ন
শান্ত কোন দূর আকাশের।
( ‘ আমরা যাইনি যুদ্ধে, ‘ ” সম্রাট “)
৪) মৃত্যু- শোক- স্তব্ধ মনে, সে পাখার ধ্বনি,
শুনি চলে বিরাম বিহীন,
কুলহীন সাগরে সাগরে
যুগান্তর হ’তে যুগান্তরে,
নভোসীমা করিয়া বিস্তার ( ‘ মৃত্যুত্তীর্ণ ‘, ” ঐ “)
৫) মৃত্যু ও রাত্রির দুর্গ যেখানে যেথায়,
খুঁজে খুঁজে নিয়ে
অবিরাম অবরোধে আপনারে নিঃশেষে আহুতি
… এই তার নির্মম নিয়তি
( ‘ ইস্পাত ‘, ” ফেরারী ফৌজ “)
৬) মৃত্যুবাহ দুর্ভিক্ষ ও মরকের
দিগ্বদিক ঢেকে-দেওয়া শকুন – ডানার
ছায়া পড়ে গাঢ় হয়ে ;
( ‘ জনৈক ‘, ” ঐ “)
৭) রক্ত এখনও দিতে হবে ঢের
দিতে হবে আরও প্রাণ,
মৃত্যুর তীরে জীবনের ধ্বজা ওঠাতে।
( ‘ জীবনের গান, ‘ ” সাগর থেকে ফেরা “)
৮)মৃত্যুর তমিস্রায় সমস্ত পৃথিবী যখন নিমগ্ন,
অকম্পিত সে শিখা
তখনও জ্বলে পর দুঃসাহসে
( ‘ সূর্যবীজ ‘, ” ঐ “)
৯) জন্ম -মৃত্যু -ডোর হতে খসে গিয়ে তবু,
একটি জ্যোতিষ্ক – সত্তা
মানুষের ইতিহাসে
রেখে দিয়ে গেল না কি
সূর্যাংশের শাশ্বত সাক্ষর ‘?
( ‘ জ্যোতিষ্ক সত্তা ‘, ” অথবা কিন্নর “)
১০) চকিত বিদ্যুতে কি যে রেখে গেছে দুর্বোধ
নির্দেশ
মৃত্যু আর জীবনের সব তুচ্ছ সীমান্ত ছাড়িয়ে।
( ‘ শোন ‘, ” কখনো মেঘ “)
১১) দুঃখ ও মৃত্যুর সাথে
তুমি শুধু হেঁটে হেঁটে ঘুরে সমুৎসুক
আবিষ্কার করে গেছো
কিমাশ্চর্য মানুষের মুখ।
(‘ম্যাক্সিম গর্কি- কে নিবেদিত’,” নদীর নিকটে”)
১২) তার উল্লাস লাল বিদ্যুতে
মৃত্যুকে মানে দেবে না
আর তো দেবে না।
( ‘ হরিণ চিতা চিল’,” হরিণ চিতা চিল”)
উপরিউক্ত উদাহরণ গুলিতে লক্ষ্য করা যায় কবিমনের নানান বৈচিত্র্য। মৃত্যু কখনো কবি মনকে করেছে বেদনায় আচ্ছন্ন,কখনো মৃত্যুকে ঘিরে কবিমনে জমা হয়েছে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, কখনোবা মৃত্যুকে কবি প্রেমেন্দ্রের মনে হয়েছে নিষ্ঠুর নিয়তি। আবার কখনোবা দেখেছেন পরম প্রাপ্তির আগের মুহূর্ত হিসেবে। আবার, মৃত্যুর নগ্নরূপ প্রত্যক্ষ করে কবি প্রেমেন্দ্র তা ঢাকার জন্যই মৃত্যুকে জয় করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন লক্ষ্য করা যায়।
প্রেমেন্দ্র মিত্র এ-ও বিশ্বাস করতেন, স্বপ্ন মৃত্যুহীন না হলে অমৃতলোকে পৌঁছানো যায় না।

চলবে ক্রমশ…..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *