ইতিহাসের আলোকে কিরাত ভূমি ******** গৌতম নাথ
ইতিহাসের আলোকে কিরাত ভূমি
গৌতম নাথ
ত্রিপুরা জাতি যে ভাষায় কথা বলে তা কক্-বরক নামে অভিহিত। কক্-বরক্ ভাষাটি ৫৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যের রাষ্ট্রভাষা ছিল। ত্রিপুরা ভারতে যোগ দিলে কক্-বরক্ রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা হারায়। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি ভারত সরকার কর্তৃক কক্-বরক্ পুনরায় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে।
ত্রিপুরা জাতির সামাজিক কাঠামো পিতৃতান্ত্রিক। পিতাই পরিবারের প্রধান এবং তার অবর্তমানে জ্যেষ্ঠ পুত্র পরিবারের কর্তা হন। এক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রমও দেখা যায়। কোন কোন গোত্রে কন্যা সন্তানদের মাতৃবংশ পরিচয়ে পরিচিত হতে দেখা যায়।
ধর্ম বিশ্বাসে ত্রিপুরা জাতি সনাতন ধর্মের অনুসারী। মধ্যযুগে একমাত্র ত্রিপুরা রাজ্যটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে আখ্যায়িত ছিল। বর্তমানকালে ত্রিপুরীদের অনেকে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছে।
ত্রিপুরীরা ৩৬টি দফা বা গোত্রে বিভক্ত। এগুলি হলো: গুরপাই, রিয়াং, খালি, জমাতিয়া, নাইতং, কেওয়া, কেমা, দেনদাক, গাবিং, আসলং, তংপাই, আনোক, ফাতং, গর্জং, খাকুলু, কলই, মোকছাক, মুইচিং, উসুই, গাইগ্রা, বেরী, রুক্কিনী, মলসম, হারবাং, রংচের, বঙ, জানতং, চরই, দাম্পা, মংবাই, হালাম, কলি, মুরাসিং, মাখ্রা এবং মাইপালা।
ত্রিপুরীদের বর্ষপঞ্জিকার নাম ত্রিপুরাব্দ। সংক্ষেপে লেখা হয় ‘ত্রিং’। ত্রিপুরাব্দ বর্ষপঞ্জিকা বঙ্গাব্দ থেকে ৩ বছরের প্রাচীন ও মগাব্দ থেকে ৪৮ বছরের প্রাচীন। তবে খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫৯০ বছরের কনিষ্ঠ। ত্রিপুরাব্দ বর্ষপঞ্জিকা ৫৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতবর্ষের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে প্রচলিত ছিল। এখনও ত্রিপুরী জনজীবনে এ পঞ্জিকার প্রচলন রয়েছে। ত্রিপুরাব্দ সৌরবর্ষ ভিত্তিক পঞ্জিকা। রাজমালা গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, ত্রিপুরা মহারাজা বীররাজ হামতর ফা ৫৯০ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশ জয় করেন। ত্রিপুরাদের বিয়ে রীতি সাধারণত তিন ধরনের: (১) কাইজারাই কৌচাং বা প্রজাপত্য বিয়ে (২) কাইজালাই বচং বা গন্ধর্ব বিয়ে এবং (৩) কাইজালাই কুসুর বা অসুর বিয়ে। ত্রিপুরী জনজীবনে দুই পদ্ধতিতে বিয়ের অনুষ্ঠানাদি সম্পাদন করা হয়ে থাকে: তান্ত্রিক পদ্ধতি, বৈদিক পদ্ধতি। তান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিয়ে উপলক্ষে দুটি পূজানুষ্ঠান করা হয়ে থাকে। এ দুটি পূজানুষ্ঠানের নাম ‘চুমলাই পূজা’ ও ‘কাথারক পূজা’। ত্রিপুরা সমাজে সকল গোত্রের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক সিদ্ধ। তবে রক্ত সম্পর্কীয় তিন পুরুষের মধ্যে বিবাহ বন্ধন নিষিদ্ধ।
বৈদিক পদ্ধতিতে পুরোহিত সমগ্র বিয়ে কার্যাদি পরিচালনা করে থাকেন। এ পূজানুষ্ঠানের অধিদেবতার নাম ‘প্রজাপতি’ আর এ কারণে ত্রিপুরীদের বিয়ে সম্পর্কিত নিমন্ত্রণ পত্রের উপরে ‘শ্রী শ্রী প্রজাপত্রয়ে নম:’ এই বাক্যটি উৎকীর্ণ থাকে।
বিশেষ কোনো কার্য উপলক্ষে আয়োজিত ভোজানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য আয়োজক কর্তৃক আহবান করাকে ‘নিমন্ত্রণ’ বলে। ত্রিপুরী জনজীবনে নিমন্ত্রণ সংস্কৃতিকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। যে ভোজানুষ্ঠানের সাথে আনন্দ, উচ্ছ্বাস, অনুপ্রেরণা ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে ত্রিপুরা ভাষায় এমন ভোজানুষ্ঠানকে ‘পানা’ বলে। যেমন জন্মবার্ষিকী ও বিবাহঅনুষ্ঠান। আর যে ভোজানুষ্ঠানের সাথে দুঃখ, বেদনা, শোক বিরহ নিহিত রয়েছে এমন ভোজানুষ্ঠানকে ‘সামৌং’ বলে।
ত্রিপুরীদের জীবন ও জীবিকা, আচার আচরণে গীতি নৃত্য ও বাদন অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে জড়িয়ে আছে। লোকাচারে কোন ত্রিপুরা যখন বিবাহের অনুষ্ঠান করে তখন তাকে অবশ্যই গীতি বাদ্য ও নৃত্য সহকারে অনুষ্ঠান সম্পাদন করতে হয়। এমনকি যখন কোনো ত্রিপুরা জন্মগ্রহণ করে তার আগমনী বার্তাও ঘোষিত হয় শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে। আর যখন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয় তারও সমাপ্তি টানা হয় গীত, বাদ্য ও নৃত্যের মাধ্যমে। (ক্রমশঃ)