আমি যখন কবিতা পাঠক — বিবেকানন্দ মণ্ডল
আমি যখন কবিতা পাঠক
— বিবেকানন্দ মণ্ডল
বন্ধুমহলে কবিতা পাঠের প্রসঙ্গ উঠলেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে অধিকাংশের মুখে একটি অনীহা এবং মুখোবিকৃতি লক্ষ করি ।
বর্তমানে কবিতার প্রতি সাধারণ পাঠকের এমন অনীহার কারণ কী ? — একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে কবিতার বই খুলে বসে অনেকবার সেকথা ভেবে দেখেছি ।
মনে পড়ে , ছোটবেলায় মাথা নেড়ে নেড়ে কবিতা পড়তাম , পড়তে ভালো লাগত ; বোধ করি সমস্ত সাধারণ পাঠকের ক্ষেত্রেই তাই । তখন কবিতার ভাববস্তু হয়তো কিছুই বুঝতাম না , শুধু ভাব এবং ভাষার বাহ্যিক দোলাটুকুতেই তৃপ্ত হতাম ।বড় হয়ে যখন সেই দোলার সঙ্গে হৃদয়ভাবটুকুর হদিশ পেলাম তখনই সেই কবিতার অনির্বচনীয়তা আমাকে স্পর্শ করল ।
বর্তমানে কিছু সংখ্যক কবির কথা বাদ দিলে অধিকাংশের ক্ষেত্রেই লক্ষ করি — দরজা জানালা সব যেন বন্ধ ! প্রথমেই হোঁচট খাই । আবার চেষ্টা করি কোনোরকমে ঢোকার কিন্তু কোনো ফাঁক ফোকর না পেয়ে বিমর্ষ হয়ে পড়ি । সেই মুহূর্তে একটাই কথা মনে হয় — বাহ্য হলেও যেটি কবিতার মূল উপকরণ সেই ভাষার মধ্যে ছন্দের অভাব । ছন্দ বলতে আমি আলঙ্কারিক ছন্দের কথা বলছি না ; বলতে চাইছি ভাষার স্বাভাবিক ছন্দের কথা , তালের কথা , শ্রুতি মধুরতার কথা যা আমাদের বোধগম্যতাকে সহজ-সুন্দর করে তোলে । এখানে ছেদ-যতির একটি অনিবার্য গুরুত্ব আছে । এখনকার কবিতায় তার নির্দেশ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে না ।ফলে আমরা পাঠকেরা বিভ্রান্ত হই । যদিও ভাবযতি অনুযায়ী চরণ শেষ করলে সেই অসুবিধা সবসময় থাকেনা । কিন্তু সেটাই বা করে থাকেন কজন কবি ?
ফলত , যে দরজা দিয়ে কবির হৃদয়ের সঙ্গে আমাদের পাঠক হৃদয়ের যোগ ঘটবে সে পথই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে । আমরা পাঠকেরা বীতরাগ হচ্ছি কবিতার প্রতি । এর সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে অতিমাত্রিক আলঙ্কারিক প্রয়োগের ভয়ঙ্করতা ! কবিতার পাঠক হিসেবে এটুকু জ্ঞান অন্তত আছে যে , আধুনিক কবিতার পাপড়ি খুলে খুলে পড়তে হয় । সেখানে সংকেত , প্রতীক , ব্যঞ্জনা শব্দের কিম্বা বাক্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অন্য রসায়নে । যেমন — ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন ‘ । পাখির বাসার মতো ভয়ঙ্কর চোখ ! আমরা প্রথমেই চমকে উঠি ! কেমন প্রেমীক রে বাবা , প্রেমীকার চোখের এমন বিদ্ঘুটে উপমা টানে ! কিন্তু ‘পাখির নীড়’ শব্দটিকে স্নেহ-মমতার প্রতীক ধরে নিতে পারলেই সেই রসায়নে আমরা ঢুকে যেতে পারি । কিন্তু এই অলঙ্কার প্রয়োগের কৌশল এবং মাত্রা বজায় থাকলেই তা পাঠক হৃদয়কে আকর্ষণ করতে পারে । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন — “নারীর যেমন শ্রী এবং হ্রী , সাহিত্যের অনির্বচনীয়তাটিও সেইরূপ । তাহা অনুকরণের অতীত । তাহা অলঙ্কারকে অতিক্রম করিয়া উঠে , তাহা অলঙ্কারের দ্বারা আচ্ছন্ন হয় না ।” বর্তমান অধিকাংশ কবিতায় এই মাত্রাজ্ঞানের সঙ্গে আলঙ্কারিক প্রয়োগ হয়না যেখানে , সেখানেই দুর্বোধ্যতা আচ্ছন্ন করে এবং কবির সঙ্গে আমাদের পাঠক হৃদয়ের দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে ।
জানি পাঠককেও সহৃদয় পাঠক হতে হয় । কিন্তু কবিরা যদি সেই সহৃদয়তার দায়টুকু শুধুমাত্র পাঠকের উপর চাপিয়ে দিয়ে খালাস হতে চান তাহলে পাঠকের দায়ও স্বাভাবিক ভাবেই আলগা হওয়ার কথা ।
পরবর্তী কথা হল — কবিতার অবয়বের মধ্যে একটি নিটোল ভাবরূপ , ভাবসংযোগ যখন না পাই তখন কবির মূল বক্তব্য , দর্শণ ,বা উপলব্ধি আমাদের পাঠক হৃদয়ে অনুরূপ চিত্র গঠন করতে পারে না । ফলে আস্বাদনীয়তা কখনো কখনো তিক্ততা উৎপাদন করে । কবিতার পূর্ণতা তো কবি হৃদয়ের সঙ্গে পাঠক হৃদয়ের রসায়নে ।রবীন্দ্রনাথ ‘সাহিত্যের তাৎপর্য’ প্রবন্ধে বলেছেন — “যে মানসজগৎ হৃদয়ভাবের উপকরণে অন্তরের মধ্যে সৃষ্ট হইয়া উঠিতেছে তাহাকে বাহিরে প্রকাশের উপায় কী ? তাহাকে এমন করিয়া প্রকাশ করিতে হইবে যাহাতে হৃদয়ের ভাব উদ্রিক্ত হয় ।” — কার মনে ? নিশ্চয়ই পাঠকের মনে । সেই পাঠকের মনের দিকে ন্যূনতম নজর দেননা যখন কবিরা তখনই ‘হৃদয়ে হৃদয় যোগ’ হয় না । কবি এবং পাঠক উভয়েই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরস্পর নির্বাসিত হন ।
তবে , বলতেই হয় সব কবির সব কবিতার ক্ষেত্রে সেটা হয় না । অনেক কবিতাই পড়তে পড়তে বুঁদ হয়ে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি নিয়ে তৃপ্ত হয়ে উঠি । কিন্তু সংখ্যায় তা খুবই কম । তাই বোধ করি আমার মতো অনেক সাধারণ পাঠকবন্ধুরও কবিতার প্রতি (বিশেষত বর্তমান কবিতার প্রতি ) একটি অনীহা বা মুখোবিকৃতি লক্ষ করা যায় । কখনো কখনো কারো কারো মুখে শুনি — ‘বর্তমান কবিরা নিজেরাই বোঝেন কি নিজের কবিতা ?’ কখনো কখনো প্রশ্নটা আমার মনেও কবিতা পাঠ করতে গিয়ে মাথা তুলে জেগে ওঠে …