মিস্ জোসেফিন ম্যাকলাউড —- মীনা দে

মিস্ জোসেফিন ম্যাকলাউড
মীনা দে

এক সময় এক ভারতীয় হিন্দু সন্ন্যাসীকে একজন আমেরিকান মহিলা প্রশ্ন করে ছিলেন, আমি আপনার জন্য কি করতে পারি? উত্তরে সন্ন্যাসী বলেছিলেন, “ ভারতবর্ষকে ভালোবাসো” । সন্ন্যাসী অবশ্যই স্বামী বিবেকানন্দ আর আমেরিকান মহিলা মিস্ জোসেফিন ম্যাকলাউড । হ্যা জোসেফিন সত্যিই ভারতবর্ষকে ভালবেসে ছিলেন। তাঁর কাছে ভারতবর্ষ মানেই বিবেকানন্দ আর বিবেকানন্দ মানেই ভারতবর্ষ ।
শান্তপ্রকৃতির জোসেফিনের শরীরে ছিল অদম্য কৌতুহল। অসীম সাহস এবং অফুরন্ত উৎসাহ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মধ্যে দেখা দেয় জ্ঞানলাভের স্পৃহা । ধর্ম ঈশ্বর মানুষ ইত্যাদি সম্বন্ধে বিস্তারিত জানার জন্য তিনি উৎসুক হতেন এবং উত্তর জানার জন্য বিভিন্ন বক্তৃতার আসরেও উপস্থিত হতেন। এই রকম এক বক্তৃতার আসরেই তিনি বিবেকানন্দের দর্শন পান। জোসেফিন বলতেন তাঁর প্রকৃত জন্ম সেইদিই হলো যেদিন তিনি প্রথম বিবেকানন্দকে দেখলেন। এইদিন জোসোফিন জানতে পারলেন যে সুদূর ভারতবর্ষ থেকে এক অতি আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ এসেছেন যিনি নিউইয়র্কের ওয়েষ্ট স্ট্রীটের একটা বাড়ির বসার ঘরে বক্তৃতা দেবেন। এমন দক্ষ বক্তা নাকি সচরাচর দেখা যায় না। জোসেফিন তাঁর দিদি বেসিকে নিয়ে সেখানে পৌঁছলেন। দেখলেন যে , কোন চেয়ারই খালি নেই। এমনকি মেঝেতেও অনেকে বসে পড়েছেন। তাঁরাও সামনে গিয়ে মেঝেতে বসে পড়লেন। দেখলেন যে, কিছুক্ষণ পরেই ঘরে প্রবেশ করলেন এক দিব্যজ্যোতি সম্পন্ন পুরূষ যাঁর পরনে ছিল উজ্জ্বল কমলা রং এর লম্বা পোষাক , আশ্চর্য দীপ্তিময় দুই চক্ষু। তিনি একটা কোণায় গিয়ে দাঁড়ালেন। এই অপূর্ব দর্শন সন্ন্যাসীর দিকে তাকিয়ে জোসেফিন এমনই -করা অভিভূত হয়ে পড়লেন যে তিনি আর কিছু মনে রাখতে পারলেন না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে রইলেন। জোসেফিন লিখছেন।

তাঁর উপস্থতিতে মনে হল প্রচন্ড এক শক্তি গোলকের সামনে যেন আমরা বসে আছি। সেই মুহূর্ত থেকে জীবনের মানেটাই যেন পাল্টে গেল । এরপর থেকে প্রতিদিন তাঁরা বক্তৃতা শুনতে যেতেন। জোসেফিন প্রথম স্বামীজীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেলেন যখন একদিন স্বামীজী তাঁর কাছে জানতে চাইলেন তাঁরা সম্পর্কে একে অপরের বোন কিনা এবং তাঁরা কতদূর পথ অতিক্রম করে আসেন। তার উত্তরে ডোসেফিন জানালেন, তাঁরা সম্পর্কে বোন এবং তাঁরা ত্রিশ মাইল পথ অতিক্রম করে আসেন। তারপর একদিন জোসেফিন ধ্যান কি ভাবে করতে হয় সে সম্পর্কে স্বামীজীর কাছে জানতে চাইলে স্বামীজী তাঁকে ওঁ মন্ত্র দান করলেন। এবং ধ্যানের প্রক্রিয়া অবগত করালেন। স্বামীজীর দেওয়া প্রত্যেকটি বক্তৃতা যেন নিজের কাছে সঞ্চিত রাখতে পারেন সেই জন্য জোসেফিন একজন দক্ষ স্টেনোগ্রাফারের সাহায্য নিলেন। ইনিই মিস্টার গুডউইন। গুডউইন কিন্তু তাঁর পারিশ্রমিক নিতে অস্বীকার করে ছিলেন এই বলে যে, স্বামীজী যদি নিজের জীবন দান করতে পারেন তবে আমি কেন আমার কাজটাকে উৎসর্গ করতে পারব না? এরপর স্বামীজী জোসেফিনের সঙ্গে বন্ধুর মতোই ব্যবহার করতেন আর জোসেফিন বলতেন স্বামী বিবেকানন্দ আমার বন্ধু। এমন এক বন্ধু যিনি ভগবানকে জেনেছেন।
স্বামীজী যখন লন্ডন গেলেন লন্ডনের প্রিন্সেস হলে বক্তৃতা দেবার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে, জোসেফিনও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। বক্তৃতা দেবার পরদিন সমস্ত সংবাদ পত্র তাঁর বক্তৃতার অকুন্ঠ প্রসংশা করে খবর ছেপেছিল যে এমন একজন যোগী পুরুষ লন্ডনে এসেছেন যাঁর বাগ্মীতায় হাজার হাজার দর্শকশ্রোতা মুগ্ধ এবং বিস্মিত। সেইদিন জোসেফিন খুবই গর্ব অনুভব করে ছিলেন। এই লন্ডনেই একটা বক্তৃতার আসরে মার্গারেট নোবলও আসেন এবং এখানেই জোসেফিন তাঁর সঙ্গেও পরিচিত হন। বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত এবং স্বামী সারদানন্দও এই সময়ে লন্ডনে আসেন ও জোসেফিনের সঙ্গে পরিচিত হন। তাঁরা স্বামীজীর প্রতি জোসেফিনের ভক্তি এবং বিশ্বাসের গভীরতা দেখে বিস্মিত হয়ে যান। লন্ডনে থাকাকালীন জোসেফিন সবসময়েই স্বামীজীর সবরকম কাজের প্রতি যেমন খেয়াল রাখতেন তেমনি আবার স্বমীজী ঠিকমতো বিশ্রাম নিচ্ছেন কিনা সেই দিকেও ছিল তাঁর সদা সতর্ক দৃষ্টি। স্বামীজীর কাজের সুবিধার জন্য তাঁর সঙ্গে অনেক লোকের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন জোসেফিনই। স্বামীজীও তাঁর অন্তরস্থিত উন্নত এবং গভীর ভাব সমূহের কথাও জোসেফিনের কাছেই মাঝে মাঝে ব্যক্ত করতেন।
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর পাশ্চাত্যের কার্যাবলী তখনকার মত শেষ করে ভারতবর্ষে ফিরে এলেন। কিছুদিন পর জোসেফিন একটি চিঠিতে জানতে চাইলেন “স্বামীজী আমি কি ভারতবর্ষে আসতে পারি?” উত্তরে স্বামীজী লিখলেন,“অবশ্যই আসতে পার যদি তুমি প্রস্তুত থাকো সব রকম বিপরীত অবস্থার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে। কতকগুলি কথা তোমাকে মনে রাখতে হবে, ভারতবর্ষে এসে তোমাকে সহ্য করতে হবে এমন সব দৃশ‍্য যা দেখতে তোমার দুই চক্ষু একেবারেই অভ্যস্থ নয়। তুমি রাস্তায় ঘাটে দেখতে পাবে অর্ধউলঙ্গ মানুষের সারি। যারা দুবেলা ঠিকমতো খেতে পর্যন্ত পায় না। সর্বত্র ধুলো বালি এবং নোংরা। তুমি হয়তো ভাল হোটেলও পাবে না থাকার জন্য। তবে হ্যা তূমি এমন অনেক মানুষ দেখতে পাবে যারা ধর্ম নিয়ে আলোচনা করছে, দর্শনের গূঢ় তত্ত্বগুলির সমাধানের সুত্র খুঁজছে। ঐ রকম বুবুক্ষু নিরন্ন হত দরিদ্র মানুষের মধ্যে এসে যদি থাকতে চাও এবং এর মধ্যে থেকে কিছু ভাল জিনিষ খুঁজে নিতে চাও তবে অবশ্যই আসতে পার।” পত্র পাওয়া মাত্র জোসেফিন এবং সারা বুল স্বামী সারদানন্দের সঙ্গে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। তাঁরা ভারতে পৌঁছনোর কিছুদিন পরে স্বামীজী খৃস্টিনকে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন, “মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড এবং মিসেস সারা বুল এখন ভারতবর্ষে রয়েছেন। তাঁরা নিজেদেরকে ভারতীয় জীবনধারার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশিয়ে নিয়েছেন। নিউইয়োর্কের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে এখানে মঠের জন্য কেনা জমিতে ছোট একটি কুটিরে তাঁরা অতি আনন্দে রয়েছেন। ” এর কয়েকদিনের মধ্যে নিবেদিতাও ভারতে এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। স্বামীজী জানতেন এই বিদেশিনীরা ভারতবর্ষকে ভালবাসলে তবেই ভারতের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করবে। তারই জন্য দরকার ছিল ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস ভারতীয় সভ্যতা এবং ভারতীয় প্রথা ইত্যাদির সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ঘটানো। এই কাজের জন্য প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে , এসব বিদেশিনীদের মা সারদার সঙ্গে পরিচিত হওয়াটা অত্যাবশ্যক বলে মনে করলেন স্বামীজী এবং সেইমতো তাঁদের নিয়ে গেলেন মায়ের কাছে। পরিচয় পর্ব শেষ হবার পর জোসেফিনের অনুরোধে মা সারদাও তাঁদের সঙ্গে বসে খাবার খেলেন। স্বামীজীও বুঝলেন মা এই সব বিদেশিনীদের হিন্দু সমাজে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। স্বামীজী এরপর ভারতভ্রমনে বেরহলেন বিদেশিনী শিষ্যাদের নিয়ে। উদ্দেশ্য একটাই ভারতবর্ষকে চেনানো। ভারতের মাটির সঙ্গে তাঁদের আত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করা। ভ্রমন শেষে জোসেফিনকে আমেরিকায় ফিরে যেতে হলো বটে কিন্তু তিনি সেখানে গিয়ে আর মন বসাতে পরলেন না। বার বার মনে হতে লাগল তাঁর যে সংসারের কাজ করা মানেই সময়ের অপচয় করা। তিনি নিজেকে ডুবিয়ে দিতে লাগলেন ভাগবত গীতা ইত্যাদি গ্রন্থপাঠে।
দ্বিতীয়বার যখন স্বামীজী আমেরিকা গেলেন তখন তাঁর শরীর খুব একটা ভাল ছিলনা কিন্তু জোসেফিন সবসময় ছায়ার মতো তাঁকে অনুসরণ করতেন। তাঁর সঙ্গে থেকে জোসেফিনও ঠাকুর রামকৃষ্ণ এবং বিবেকানন্দের ভাবধারা পৃথিবীর সব জায়গায় ছড়িয়ে দেবার কজে সাহায্য করেছেন। বেদান্ত সোসাইটির দায়িত্বভারও নিজের কাঁধে বহন করে ছিলেন। স্বামীজী দেশে ফিরে আসার পরও জোসেফিন স্বামীজীর কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
জোসেফিন যখন ইউরোপে তাঁর প্রচারের কাজে ব্যস্ত ছিলেন, তখনই একদিন বেলুরমঠ থেকে সেই দুঃসংবাদটি গেল যে স্বামীজী নির্বাণ লাভ করেছেন। জোসেফিন খবরটা পেয়ে খুব ভেঙ্গে পড়লেন কিন্তু কিছুদিন পরেই বুঝতে পারলেন যে স্বামীজীর ফেলে যাওয়া কাজ তাঁকেই শেষ করতে হবে। প্রায় চোদ্দবছর নানা কাজে নিজেকে উৎসর্গ করার পর পুনরায় ভারতে ফিরে এলেন।
স্বামীজীর বাণী সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যাতে ছড়িয়ে পড়ে তারজন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে গেছেন একবার তিনি স্বামীজীর হাতে আটশো ডলার দিয়ে বলেছিলেন এটা আপনি প্রচারের কাজে লাগাবেন। স্বামীজ তখনি ত্রিগুণাতীতানন্দ মহারাজকে ডেকে বললেন এই টাকা দিয়ে ছাপাখানা কেনার ব্যবস্থা করো এবং উদ্বোধন পত্রিকা প্রকাশের কাজ শুরু করে দাও। টাকার অভাবেই যে কাজটা মনস্ত করেও করা যাচ্ছিল না। স্বামীজীর কার্যাবলী লিপিবদ্ধ করে রাখার কাজে জোসেফিনই নিবেদিতাকে উৎসাহিত করেছিলেন। নিবেদিতাকে বহু লোকের কাছ থেকে স্বামীজীর লেখা চিঠিপত্র সংগ্রহ করে এনে দিয়েছিলেন। যখন রোঁম্যা রোঁল্যা রামকৃষ্ণ এবং বিবেকানন্দের জীবনী লেখার কাজে ব্যস্ত ছিলেন তখন জোসেফিন তাঁকে প্রচুর তথ্য জোগাড় করে দিয়েছিলেন।
এই কর্মঠ সাহসী স্নেহপ্রবনাএবং সদালাপী মহীয়সী নারী একানব্বই বছর বয়সে রামকৃষ্ণ ধামে যাত্রা করেন । মৃত্যুর সময় তার মুখে ছিল মৃত্যুকে ভয় না করে জয় করবার হাসি।

এই লেখাটা তুমি কোনো এক সময় নিও সই। এটা আমার অনূরোধ তোমার কাছে। এই লেখাটা অনেক পড়াশোনা করে তারপর লিখেছিলাম অনেক যত্ন করে। আজ বের করলাম। পড়ে দেখো ভালো লাগবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *