“” আমিঃ ভারতীয় চন্ডাল “” “” আপনি কি বাঙালি? ‘” কলমেঃ সঞ্জয় বিশ্বাস
“” আমিঃ ভারতীয় চন্ডাল “”
“” আপনি কি বাঙালি? ‘”
কলমেঃ সঞ্জয় বিশ্বাস
—————————————
” আপনি কি বাঙালি “?
—- প্রশ্নটা আমায় করেছিলেন এক ভদ্রলোক( নাম নাইবা শুনলেন)
— হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে— নিজের দিকে একবার ভালো করে তাকিয়ে নিলাম।
পরনে ধুতি পাঞ্জাবি নেই —
হিন্দি গান শুনছিলাম। কথ্য ভাষাটাও–হিন্দি-বাংলা-টুটাফুটা ইংরেজির সংকর মিশ্রণ।
—সংস্কৃতিটা মনে করতে গিয়ে দেখি– রাম -জিশু -মহম্মদ মিলেমিশে একাকার।
— কি উত্তর দেবো ভেবে খানিকটা সময় ওয়েট করলাম।
তবে উপস্থিত বুদ্ধিমতো তার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম।
—-বলেছিলাম জানি না বাঙালি কিনা? বাঙালি হওয়ার শর্তগুলিও জানি না;
তবে নিজেকে একজন— ” ভারতীয় অনার্য চন্ডাল” মনে করি…
— মোটা গলায় উত্তর এলো— এমন জাত আবার হয় নাকি?
——–“খানিকটা চুপচাপ রইলাম!
—- তাল বুঝে ঝপাত করে আমি উল্টে প্রশ্ন করে বসলাম—
–“দাদা আপনি কি বাঙালি”??
—গম্ভীরমুখে ; ‘হুম’।
———-“আমি হুন রক্তহীন অস্ট্রোএশিয়াটিক দ্রাবিড় জাতির বংশধর”।
—–“আর শুনুন,এটাই বাঙালি হওয়ার মাপকাঠি! “বুঝলেন”?
———-‘বাংলায় জন্মালে আর বাংলা ভাষায় কথা বললেই সে বাঙালি হয়ে যায় না— বুজলেন তো’??
—–“ঢোক গিলে বললাম”– হুম।।
———” মুখ বাড়িয়ে “মুখোপাধ্যায়” টাইটেলটা দেখে নিলাম….ভদ্রলোকের।
—-ওপাস থেকে আবার একই প্রশ্নঃ
বললেন না তো- — “আপনি কি বাঙালি”?
— “সবিনয়ে উত্তর”;
——জানি নে দাদা;বাঙালি কিনা!
——– তবে—-জন্মানোর পর ভারতমাতার (পঃবঃ)মাটি, খোলাকাশ,জলবায়ু স্পর্শ করেছি— এটা বাবা-মায়ের মুখে শোনা।
—-যদ্দুর মনে পড়ে বাবার মুখে তার বিগত তিন/ চার পুরুষের ধূসর ইতিহাস শুনেছি—-তবে, তার আগে, শক, হুন মোঙ্গল — বা অন্য কোন বহিঃ যাযাবরের রক্ত আমার শিরায় বইছে কিনা তাও জানি না।
তাই— তাই—বাঙালি কিনা! — তাও বলতে পারবো না??
—-খানিকক্ষণ ভদ্রলোক চুপচাপ রইলেন—-
——–ভদ্রলোক বললেন, —
“আপনার সুকৌশলী উত্তর আমার মনে থাকবে”।
সত্যি বলছি—-
আমি আজও বুঝতে পারিনি — আমার উত্তরটা কৌশলগত ছিল, নাকি সঠিক???
ইতিহাসের যে দুই-তিন পাতা আমার জানা ছিল( সত্যহোক বা মিথ্যা) তার কোন যুক্তি আমি আওড়াই নি?
— শুধু জিজ্ঞাসা করলাম আপনি তো আর্য ব্রাহ্মণ তাই না দাদা ?
গম্ভীর উত্তর—হুম; দ্রাবিড় ব্রাহ্মণ ;
সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন— তাহলে তো আপনি আর্য বংশধর; তাই না?
—না —মানে — আমি… আমি
আমি আসলে দ্রাবিড়। —
মনে মনে— একটু হেসে নিলাম।
—– চোখের সামনে ভেসে উঠলো বল্লাল সেনের মুখটা; ( কৌলিন্য প্রথা) আর চিনচিন করে—
ব্যথা করতে লাগলো বুকের বাঁদিকটা।
—– মনে মনে ভাবতে লাগলামঃ
——-হায়রে জাতি! হায়রে বর্ণ! হায়রে উপাধি!
তোর কৌশল আজও গেল না।
——- ভদ্রলোক খানিকটা রেগেই — আমার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হলেন।
চলুন–,
বাঙালি আর বাংলাভাষার শিকড়টা আজ সংক্ষেপে খুঁজে আসি।
খুঁজে আসি তোমার পদবী—
—–অনার্য ভারতের ইতিহাস খানিকটা আবছা জলছবির মতো। ভূমিপুত্র এবং নানা উপজাতি গোষ্ঠী ও তাদের লিখিত ইতিহাস বলতে কিছু নেই বললেই চলে—
— —আর্য আগমনের পর পৌরাণিক উপখ্যান গুলি হতে যতদূর জানা যায়।
—তাই আমি যে আর্য না অনার্য সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন—!!!
থাক আমার কথা।
———আগে দেখি
নৃবিজ্ঞানীরা কি বলেন—
————-” নৃবিজ্ঞানীরা পরিস্কার ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন—- বাঙালি সংকর জাতি ” — তার মানে– মিশ্রিত জাতি! এ নিয়ে তেমন দ্বিমত নেই।
———তাদের মতে– অনার্য নরগোষ্ঠী বাংলার আদি নরগোষ্ঠী। এদের উৎপত্তি — অম্বিক,দ্রাবিড়,আলপীয়,মোঙ্গলীয়,নেটিগ্রা — ইত্যাদি জাতির মিশ্রণে।
তাহলে তো—
“মুখোপাধ্যায় বাবু ”
আপনার রক্তে বৈদেশিক জাতিগোষ্ঠীর রক্ত বইছে।
——–আপনার রক্তে মিশেছে– মোঙ্গল,শক,হুন,তুর্কী, আফগান,মোঘল এমনকি ইংরেজেদের জিন।
তাই নয় কি?
—–“আরে আপনি খাটো কেন”?
——-“আবার, সাঁওতাল মেয়েটি ফর্সা কেন”?
——“আপনি কালো কেন”?
——–“আপনার নাক থ্যাবড়ানো কেন”?
——–“আমার নাক টিকলো কেন”?
তাহলে—-
——-“আমি বাঙালি নাকি আপনি”?
—–“আমি আর্য নাকি আপনি”?
——“আমি ব্রাহ্মণ নাকি আপনি শুদ্র”?
—- না,আমার জানা নেই এসব প্রশ্নের উত্তর।
শুধু মনে হয়—
—-“এ সংস্কৃতি কালের স্রোতে ধর্ষিত হয়েছে বারংবার”।
আর কালে কালে—-
——–” বন্দুকের নলই হয়ে উঠেছে সকল ক্ষমতার উৎস ”
——–” সজ্ঞান দ্বারা প্রতারিত অজ্ঞান ” আজও হচ্ছে।
———“পুকুরের ছোট মাছেরা বড় মাছ দ্বারা ভক্ষিত হয়েছে”— নিখাত বাস্তুতন্ত্র।।
মুখোপাধ্যায় বাবু—- সবই কৌশল ;
— আপনার কোমরের একগাছা সুতো— কখন যে কার ফাঁসিফাঁদ হয়ে উঠেছে তা কেউ টের পাইনি।
তাই বিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায়—–
— রিজারভেশন= অস্বস্তি।।
হা হা হা হা—–
আশাকরি– আপনি বুঝে গেছেন?
হ্যাঁ ঠিক তাই—
—–বাঙালির রক্তে মিশ্রিত আছে বহু বিচিত্র নরগোষ্ঠীর অস্তিত্ব। জাতিতাত্বিক নৃবিজ্ঞানীদের মতে–পৃথিবীর প্রধান চারটি নরগোষ্ঠীর (নিগ্রীয়,মঙ্গোলীয়, ককেশীয়,অস্ট্রোলীয়) প্রতিটি কোন কোন শাখায় আগমন ঘটেছে।
ভারতের আদি জনগোষ্ঠীর ( সাঁওতাল, বাঁশফোড় রাজবংশী ইত্যাদি) দ্বারা নির্মিত সমাজ ব্যবস্হা,সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় আর্য আগমনের পর থেকে।
আজকের বাঙালী ভারতের আদি জনগোষ্ঠীর বাহক হলেও—কালের বিবর্তনে পরিবর্তিত হয়েছে তাদের — ভাষা,বর্ণ, গড়ন,সংস্কৃতি।
….বৈদিক স্তুতিতে বাঙালির উল্লেখ না পেলেও ঐতরীয় ব্রাহ্মণে— বঙ্গজাতির সূত্র মেলে।
— তবে বলা আছে আর্যাবর্তের পূর্বে রাক্ষস দস্যুদের বাস ছিল—
আবার রামায়ণের এক তালিকায়— আর্যদের সাথে বঙ্গজাতির মিত্রতার উল্লেখ মেলে।
— ঐতিহাসিক যুগ বলছে—প্রথম বঙ্গজ জাতির উল্লেখ করেন– গ্রীক পন্ডিতরা। তাদের বর্ননায়— গৌড়, হরিকেল,চন্দ্রদ্বীপ,পুন্ড্রু,বরেন্দ্রী,দক্ষিনাগড়,তাম্রলিপ্ত সুবর্ণবীথীর উল্লেখ মেলে। ————-পরবর্তীতে
শশাঙ্কের সময়ে বিক্ষিপ্ত পদ গুলিকে খানিকটা একত্রিত করা হয়েছিল।
————–সুলতানি যুগে–এই জনপদের বা রাষ্ট্রের নাম দেওয়া হয়–“বাঙলাহ” যা আজকের “বাংলা”।
——-সর্বোপরি পাল ও সেন যুগে এসে– বাঙালি জাতি সংঘটিত ও বিকশিত হয়। ——পরিচিতি লাভ করে বাঙালি হিসাবে —
— রাজরক্ষক থেকে সাধারণ মানুষ ক্ষমতা,বংশ,কর্ম ইত্যাদির ভিত্তিতে উপাধি লাভ করে।
—কুশলী বুদ্ধিদীপ্ত তথাকথিত অকর্মণ্য আর্য মস্তিষ্কের অভিশপ্ত বর্ণভেদ ভাইরাস উপাধির শিরা উপশিরা বেয়ে আজও সমাজে সবচেয়ে বড় মানবিক অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
—-“মুখোপাধ্যায় বাবু”
তাইতো,
— গর্ব করে আপনাকে বললাম–
“আমি ভারতীয় চন্ডাল”
এবার আমি প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে পারবেন তো?
“” আপনি কি বাঙালি?
আপনি— প্রমাণ দিতে পারবেন তো– “আপনি বাঙালি”!
—আপনি চেষ্টা করুন। শুধু আমি একটা কথা পরিস্কার বলে রাখি— ” এই সংকর বাঙালি ও ধুরন্ধর আর্য মিশ্রণের দিব্য দিয়ে বলছি— এরা কোনদিন “ইউনিটি” হতে শেখেনি। ” কাঠি “এদের জিনগত প্রাপ্তি।
—–চলুন এবার ঘুরে আসি— এই সংকর বাঙালি বাংলা ভাষা পেল কোথায়?
—–শোনা যায় আর্যদের কথ্য ভাষা– গৌড়ীপ্রাকৃত।তবে প্রাচীন ভারতে আর্যভাষা বলতে বোঝায়– বেদের ভাষা; খানিকটা প্রকট সংস্কৃত।
ইতিহাস বলছে— ইন্দোইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর থেকেই আজকের বিবর্তিত ” বাংলা ভাষা ”
—-এই ইন্দোইউরোপীয় ভাষার “শতম” শাখা হতে—“আর্য ভাষার” উৎপত্তি। পানিনি সপ্তম শতকে আর্য ভাষার পরিমার্জন ও সংস্কার করেন। সংস্কারের শিথিলতার ফলে যে ভাষা আসে তাই “সংস্কৃত” ভাষা নামে পরিচিত। যদিও আর্য যুগে এই ভাষা সারাভারতে ছড়িয়ে পড়ে। পরে সংস্কৃতের শিথিলতায় পালি ভাষার জন্ম হয়।— আর এই পালি ভাষার সঙ্গে অনার্যদের ভাষার মিশ্রণে সৃষ্টি হয় — প্রাকৃত ভাষা। সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে এই ভাষা প্রাধান্য লাভ করে। এই প্রাকৃত ভাষার কয়েকটি আঞ্চলিক রূপ ছিল–,পূর্বে মাগধী অপভ্রাংশ ভাষা থেকে কয়েকটি বিহারী আঞ্চলিক ভাষার( মাগধী মৈথিলী, ভোজপুরী) জন্ম হয়। এছাড়া পূর্বী অপভ্রাংশ থেকে — বাংলা অসমীয়া ও ওড়িশি ভাষার জন্ম হয়।
—-জর্জ গ্রিয়ার্সন বলেন— মাগধী প্রাকৃত ভাষা থেকেই আজকের বাংলা ভাষা এসেছে।
—সুনীতি বাবুরা— বলেন, বাংলার আনুমানিক বয়স পাঁচ ছয় হাজার বছর। এই ভাষা কালে কালে বিবর্তিত হয়ে আসছে।যদিও তা নিয়ে ভাষাবিদরা দ্বিমত পোষণ করেন।
প্রবোধ বাগচী ও সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় আরও বলেন– বাংলার বর্তমান রূপ পরিলক্ষিত হয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে।
আর্থাৎ— বাঙালির মতো বাংলা ভাষাও “পরিমার্জিত সংকর”।
——-কালে কালে— ভাষা বিবর্তনের মধ্যদিয়ে— আজকের বাংলা ভাষা।
আর্য -অনার্য, ইন্দোইউরোপীয় ও পরবর্তী কালে— পর্তুগিজ, ওলন্দাজ,উর্দু পারসিক,ফ্রেন্স ইত্যাদি ভাষার সংকরাণের প্রসব আজকের বাংলা ভাষা।
— তাই বলছি–
মুখোপাধ্যায় বাবু,
আপনার নির্ণায়ক শর্ত গুলির বেড়াজাল ভেঙ্গে আমি বাঙালি হতে চাই না।
—- বাঙালি হিসাবে আপনার মতো গর্বও হয় না।
— খানিকটা গর্ব হয়– “একজন ভারতীয় চন্ডাল হিসাবে।”
— কাল বিবর্তনে ভূমিপুত্র অনার্য ভারতীয় বিভিন্ন সংস্কৃতি ও জাতির সংমিশ্রণে এক সংকর সংস্কৃতি বহন করে চলেছে। এই বিভিন্ন ভাষা উপভাষা,অঞ্চলিক কথন,আর বিচিত্র জাতির সহাবস্হানে—ভারতবর্ষ তার শিরা উপশিরায় বয়ে নিয়ে চলেছে ” সমগ্র পৃথিবীর সংস্কৃতির সারাংশ।
তাই—-আমি বাঙালি কিনা তাতে কি এসে যায়।
তাই না???
—————————————–
সূত্র– প্রাচীন ভারতের ইতিহাস +উইক্লিপিডিয়া।