গঙ্গাসাগরের পথে — কোয়েলী ঘোষ

গঙ্গাসাগরের পথে —
কোয়েলী ঘোষ

”নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ ? ”
মহাদেবের জটা হইতে ” —

” …..ছোট ছোট তরঙ্গগুলি তীর্থভূমিতে আছড়াইয়া পড়িয়া কুলুকুলু গীত গাহিয়া অবিশ্রান্ত চলিয়া যাইত । যখন অন্ধকার গাঢ়তর হইয়া আসিত এবং বাহিরের কোলাহল একে একে নীরব হইয়া যাইত তখন নদীর সেই কুলুকুলু ধ্বনির মধ্যে কত কথাই শুনিতে পাইতাম । কখনও মনে হইত এই যে অজস্র জলধারা প্রতিদিন চলিয়া যাইতেছে ইহা তো কখনও ফিরে না ; ইহার কি শেষ নাই ? নদীকে জিজ্ঞাসা করিতাম ”তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ ” ? নদী উত্তর করিত – ” মহাদেবের জটা হইতে ” তখন ভগীরথের গঙ্গা আনয়নের বৃতান্ত স্মৃতিপথে উদিত হইত । ”


ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে — আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু

ভারতের রাজধানী ছিল অযোধ্যা , রাজার নাম ভরত । ভরতের পুত্র অসিত শত্রুর কাছে পরাজিত হয়ে গেলেন বনবাসে , দুই পত্নী সাথে । জন্ম হল সগর রাজার । রাজা সগরের দুই পত্নীর একজন শিবের আশীর্বাদে জন্ম দিলেন ষাট হাজার পুত্র , আর একজন অসামঞ্জ নামে এক পুত্রের জন্ম দেন । রাজার ইচ্ছানুযায়ী অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটল ..পিছনে ষাট হাজার পুত্র । এই অশ্বমেধের যজ্ঞ সফল হলে স্বর্গ রাজ্য হারানোর আশঙ্কায় দেবরাজ ইন্দ্র ঘোড়াটিকে ধ্যানমগ্ন কপিল মুনির আশ্রমে বেঁধে রাখলেন ।


রাজপুত্রেরা এসে ঋষিকে চোর সন্দেহে আঘাত করলেন । ঋষির ধ্যানভঙ্গ হল , তাঁর ক্রোধের আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গেল সগর রাজার পুত্ররা ।
এদিকে তারা ফিরল না দেখে আসমঞ্জের পুত্র অংশুমান তাঁদের সন্ধানে গিয়ে কপিল মুনির আশ্রমে ঘোড়াটিকে দেখতে পেলেন । ঋষির কাছে জানলেন সবকিছুই , ঘোড়া নিয়ে ফেরত এলেন রাজ্যে । যজ্ঞ সম্পূর্ণ হল কিন্তু স্বর্গের মন্দাকিনীর স্পর্শেই সেই ষাট সন্তানের মুক্তি সম্ভব । তপস্যায় করেও ব্যর্থ হলেন রাজা সগর আর তাঁর পুত্র দিলীপ । দিলীপের পুত্র ভগীরথ তপস্যায় রত হলেন । নারায়ণ শঙ্খ দিলেন হাতে ।


শঙ্খ বাজিয়ে ভগীরথ চলেছেন , পিছনে গঙ্গাধারা চলেছে পিছনে কিন্তু গঙ্গার এত বেগ ধারণ করবে কে ? ভগীরথের প্রার্থনায় শিব পেতে দিলেন মাথা । জটাজালের ভাঁজে প্রবাহিত হলেন । নিজের জটাজাল ছিন্ন করে বিন্দু -সরোবরে ছুঁড়ে দিলেন গঙ্গাকে । সৃষ্টি হল সাতটি ধারা — হ্লাদিনী ,পাবনী , নলিনী তিনটি ধারা পূর্ব দিকে প্রবাহিত হল , সু চক্ষু , সীতা , সিন্ধু তিনটি ধারা পশ্চিমদিকে প্রবাহিত হল ।
গঙ্গার ধারা বয়ে গেল জহ্নু মুনির আশ্রমের দিকে ।আশ্রম ভেসে যায় দেখে জহ্নু মুনি পান করে নিলেন গঙ্গার ধারা । ভক্ত ভগীরথ আবার মুনিকে সন্তুষ্ট করলেন ।নিজের জানু ছিদ্র করে বার করে দিলেন গঙ্গাধারাকে গঙ্গাকে মুক্ত করলেন ।দেবী হলেন জাহ্নবী । এদিকে ঋষি কন্যা পদ্মা গঙ্গার সাথে মিশে গেলেন এক অংশে । পদ্মাধারা পুবমুখে প্রবাহিত হয়ে আবার দক্ষিণে এসে মিশে গেল সাগরে । আর একটি ধারা দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে কপিল মুনির আশ্রমে এসে মুক্ত করল সেই ভস্মীভুত সন্তানদের । লীলায়িত ছন্দে মিশে গেল সাগরে । খ্যাত হল সাগরসঙ্গম নামে , তীর্থের নাম গঙ্গাসাগর ।
ওপরে নীল আকাশ , সামনে ফেনিল জলধি , আর বিস্তীর্ণ সুবিস্তৃত সৈকতভুমি সাগরদ্বীপ ।


” সব তীর্থ বার বার ,গঙ্গাসাগর একবার ”
পথ ছিল দুর্গম ,যানবাহন ছিল না আগে । জলপথে নৌকায় ,হাঁটাপথে ধর্মপ্রাণ মানুষেরা, সাধুরা আসতেন বহুকষ্টে । এখন আর সেই অবস্থা নেই ।
দুবার আসা হল এই গঙ্গাসাগরে ।
প্রথমবার ট্রেনে শিয়ালদা থেকে কাকদ্বীপ স্টেশনে নেমে আট নম্বর কচুবেড়িয়া এসে গাড়িভাড়া করে এসেছিলাম ।
দ্বিতীয় বার এলাম গাড়িতে ।তারপর ভেসেলে করে এপারে এসে গাড়ি ভাড়া করে ।
এই জলপথটি খুব সুন্দর । অজস্র পাখি উড়ছে লঞ্চের চারপাশে । একটি বাচ্চা ছেলে পাখির খাবার বিক্রি করছিল । আমরা কিনে জলে ছড়িয়ে দিচ্ছিলাম আর ওরা জলের ওপর থেকে টুকটুক করে ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যাচ্ছিল ।
দুবারই গঙ্গাসাগর এসে উঠেছিলাম ভারতসেবাশ্রম আশ্রমে । এখানে কাঠের বাংলো ও আছে ।

মকরসংক্রান্তির দিনে নানা রাজ্য থেকে মানুষ আসেন ,সেই বিশাল ভিড়ের সময় আসিনি । নির্জন শান্ত গঙ্গাসাগর দেখেছি ।
এখানে কপিল মুনির আশ্রমটি অনাদি যুগের ।খ্রিস্টীয় ৪৩৪শ শতাব্দীতে এক প্রাচীন মন্দিরের অস্তিত্বের কথা জানা যায় । সেটি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে । সমুদ্রের ভাঙনে বার বার স্থান পরিবর্তন করে ছবার নতুন নতুন মন্দির স্থাপিত হয় । ১৩৮০ -৮১ সালে সপ্তম মন্দির তৈরি হয় । বিগ্রহ স্থানান্তরিত করা হয় ।

সকালে এসে স্নান সেরে নিয়েছি । হাতজোড় করে গঙ্গাস্তব পাঠ করে নিয়ে এবার যাব কপিল মুনির আশ্রম । তার মধ্যেই ঘিরে ধরেছে একদল শিশু আর তাদের মায়েরা । এত দরিদ্র মানুষ আমি আর কোথাও দেখিনি । বার বার প্রাকৃতিক বিপর্যয় ,ঝড় ,সুনামি ,রোগ সব নিয়ে জীবন -যুদ্ধে তারা বেঁচে আছে । চাষ বাস ,মাছ ধরা এদের জীবিকা । যে যার মত টাকা -পয়সা দিলাম ,কেউ বিস্কুট কিনে দিলেন ।
পায়ে পায়ে চলেছি আশ্রমের দিকে । চলার পথে দুদিকে মালা ফুল ড।লার দোকান । এক মহিলার কাছে কিনে নিলাম পুজোর সামগ্রী ।
সামনে কপিল মুনির আশ্রম । সামনেই তিনি পদ্মাসনে বসে আছেন । হাতে কমন্ডলু ,মস্তকে অনন্ত নাগ । দক্ষিণে গঙ্গা দেবী । চতুর্ভু জা , মকর বাহিনী , হস্তে শঙ্খ , চক্র , রত্ন কুম্ভ এবং বরাভয় । সঙ্গে আছেন ভগীরথ । দেবীর দক্ষিণে মহাবীর হনুমান জি , এক হস্তে গদা , অন্য হস্তে গন্ধমাদন । কপিলদেবের বাম দিকে আছেন সগর রাজা , বামপাশে অষ্টভূজা , সিংহবাহিনী বিশালাক্ষী মূর্তি । তার পাশে ইন্দ্রদেব । মন্দিরে পূজা , আরতি সম্পন্ন হলে আশ্রমের পথ ধরলাম ।

ভারতসেবাশ্রম থেকে সাগর আসার পথে কিছু দোকান আছে ।সেখানে স্থানীয় মানুষেরাই ঝিনুকের তৈরি কিছু শিল্প ,মালা ,ব্যাগ ইত্যাদির দোকান আছে । কিছু স্থানীয় মানুষের হোটেল আছে । অর্ডার দিয়ে রাখলে ওরাই রান্না করে দেয় । সেখানেই খাওয়া হল ।
একখানা টোটো ভাড়া করে ঘোরা হলো আশপাশে । সীতারাম দাস ঠাকুরের যোগেন্দ্র মঠ , মহাদেবের মন্দির ইত্যাদি দর্শন করে সাগরে সূর্যাস্ত দেখলাম ।
সূর্য তখন ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে । অদ্ভুত এক শান্তি নেমে আসছে নির্জন সমুদ্র সৈকতে । বালিতে আঁকা কত পদচিহ্ন , কত কালের বৈচিত্র্যময় ইতিহাস নিয়ে গঙ্গা মিশে যায় সাগরে ।

দেবী সুরেশ্বরী ভগবতী গঙ্গে
ত্রিভুবন তারিণী তরল তরঙ্গে
শঙ্কর মৌলি নিবাসিনী বিমলে
মমমতি রাস্তাং তব পদ কমলে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *