স্বপ্ন-সাম্পান (৪) —-//ঋদ্ধি ঘোষ
স্বপ্ন-সাম্পান (৪)
—————————-
—–//ঋদ্ধি ঘোষ
শ্রাবণও কী হার মানল—এই ভরা বৈশাখে ! মুষলধারে ঝরে যাচ্ছে , জল-কাঞ্চন…
ভিজছি— তবু কবির থেকে সরিয়ে নিইনি
চোখ । টুবুটুবু সাদা পাঞ্জাবী থেকে, ঝরে যাচ্ছে শত সহস্র মুক্তোদানা…
মুহূর্তেই চোখ সরে গ্যালো । একটা কৃষ্ণচূড়া ফুল কী সুখে— পোষা পাখির মতো উড়ে এসেছে কবির কাঁধে ! ফুল কী সত্যিই বুঝেছিল, এ ঝড়ের ভোরে কবি এত অসহায়…হয়তো বুঝেছিল বলেই ; কবিকে একা হ’তে দেয়নি সে ।
কী আশ্চর্য এই ভোর…! অথচ সেদিন মাঝরাতে যখন কাক ডেকে উঠেছিল— অন্ধকারের ভিতর থেকেই একটা নাছোড়বান্দা আলো, কপালে সূর্যরঙা লাল টিপ পরাতেই— জীবনবিমুখ একটা আগুনের সংকেতকে, চাক্ষুষ করেছিল ! বুকের বাঁদিকে হাত রেখে বুঝেছিলাম, গাছটা আর ছোটো নেই— উপেক্ষার সার-জলে বেশ অনেক গভীরে গিয়ে শিকড় ছড়িয়েছে । তবে ভয় পাইনি শিকড় পোড়ার । শুধু সে শিকড় বুঝেছিল বুকের পাড় বেঁধে ফেলতে হবে । এ জীবন ছোট্ট বাদামপাতা— নিঃশ্বাস শেষে, সব নিবেদন ভেসে যায় মাটির হাঁড়িতে…। অহেতুক আয়োজন কত—
পঞ্চ ব্যঞ্জনে উনুন জ্বালানো রোজ…!
আসলে, জল দেখতে দেখতে—নদীতীরের পাথরে চোখ রাখিনি । দেখিনি, ঢেউ ফিরে গেলে তার বুকে জমা হয় কত কত বারুদ ! ছুঁয়ে দিলেই— ব্যথার আঁতুড়গন্ধ আগুন জ্বলে ওঠে…
ছপছপ জলের শব্দ । পিছন ফিরলাম—ঝোপের আড়াল থেকে কী কেউ…?
না, কেউ নেই । আসলে, জীবনের নদীতে কখনও কখনও শাপভ্রষ্ট সময় দাঁড় টেনে যায়… নিরর্থক হবে জেনেও, আয়নার কাঁচে কেউ কেউ বিশ্বাস আঁকে । যেভাবে কচ্ছপের খোলায় ‘নির্বেদ’ শব্দ রেখে, মেঘেরা উড়ে যায়— ধ্যানমগ্ন আকাশে…
পায়ের কাছে উড়ে এলো একটা ভাঙা কাকের বাসা । চোরের মতোই এগিয়ে গেলাম । আবারও। কবির ঘরের জানলায় চোখ রাখলাম দু-মুঠো বকুল হাতে । কবিকে দেখছি— কী অদ্ভুত নির্লিপ্ত ! সব আবর্ত ভেঙে আবারও ঘাড় গুঁজে ফেললেন । যেন, ডুবে গেলেন গহন অরণ্যের সবুজে ! কোন্ মধুরা’র জীবন-গল্পের সূচিপত্র খুঁজেই চলেছেন যেন !
ইচ্ছে হল, নীলনদে শুয়ে থাকা কথোপকথনের সে শব্দরা— শুয়েই থাক আরও কিছুক্ষণ । কিন্তু পশ্চিম আকাশে, আবার ঘনকালো মেঘ—কী জানি কী বাঁশি বাজিয়েছিল সেদিন…
হাত থেকে দু’একটা বকুল পড়ে গেল, কবির বন্ধ দরজার চৌকাঠে। মনে পড়ল…
“তোমার বন্ধু কে ? দীর্ঘশ্বাস ?
আমারও তাই ।
আমার শূন্যতা গহনহীন
তোমারও তাই…?”
ঝড়ের দাপটে ছিঁড়ে যায় কত ঝুলে থাকা ঘুড়ি— তবুও ঝুলে থাকে। সাঁকোতে শ্যাওলা-দিন— তবুও বাসা বাঁধে ঘুণপোকা..
এসব ভাবতে ভাবতেই, আমি উদাসীন তাকিয়ে আছি কবির জানলায়…! দূর— থেকে ভেসে আসছে ভৈরবী সুর…
কবির ঘরে যেতে হবে । ফিরিয়ে দিতে হবে তার বুকে, তার সন্তানকে । তাই উল্টে নিলাম, কথোপকথনের সেই—না পড়া পাতাগুলো…
— অনেক বড় প্রাপ্তি আমার
— কেন
— কিছুনা
— বেশ
— আনব্লক করবার জন্য ধন্যবাদ
— ও আচ্ছা…তবে ধন্যবাদ শব্দটা অন্য কোথাও বলবেন
— আমি সকলকে ধন্যবাদ বলিনা
— ও…
— আচ্ছা , আপনি ধর্মে বিশ্বাসী ?
— হ্যাঁ… মানুষ হ’য়ে জন্মেছি, তাই মানবধর্মে বিশ্বাসী… মানবধর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম ব’লে মনে করি ও বিশ্বাসও করি…
— অবশ্যই…আমিও এটাই মনে করি
— পুজো করেন ?
— হ্যাঁ… তা-ও করি
— কার পুজো করেন
— কী হবে এসব জেনে…কীই-বা প্রয়োজন এসবের
— যদি বলি, প্রয়োজন
— আচ্ছা, আপনার কাছে ঠাকুর মানে কী বা দেবতাও বলতে পারেন
— যদি ‘ঈশ্বর’ বলি— তবে ‘ঈশ্বর’ শব্দটা আমার কাছে পবিত্রতা… আর সে ঈশ্বর মানুষের ভীতর…বলা যায়, প্রকৃতির সর্বস্বও সেই ‘ঈশ্বর’… তাই মানুষ, প্রকৃতি সবখানেই সে…তবে আরও খানিক পবিত্রতার তৃপ্তি পেতেই— হয়তো আসনে ব’সে পড়া
— আমিও এটাই বিশ্বাস করি… পাথর বা ছবিতে ‘ঈশ্বর’ বিরাজ করে না— ‘ঈশ্বর’ তো সত্যিই মানুষের মধ্যে থাকে
— যাইহোক, ভালো থাকবেন…সুস্থ ও সাবধানে থাকবেন
— সে তো সকলকেই থাকতে হবে
— বেশ
— আচ্ছা, যদি আমি সংক্রামিত হ’য়ে যাই
— এসব কেন বলছেন ?
— বাইরে দরকার ছাড়া বেরোবেন না…ভালো থাকুন
— আপনিও বেরোবেন না
— অনলাইন না-ও হ’তে পারি তাই বললাম
— দরকার পড়লে ডিলিট করব সব
— সবকিছু থেকে বিদায় নিলেও, আপনি যে আমার কাছে আপন হ’য়েই থাকবেন
— হা হা হা
— আপন ?
— হ্যাঁ…আপন
— আপনার কাছে হাসির হ’লেও, হয়তো আমার কাছে এটাই অনেকটা
— এসব ইমোশনাল শব্দ শুনতে ও বলতে কোনওটাই ভালো লাগে না
— কোনও শব্দই ইমোশনাল নয়— সবটাই আমাদের সৃষ্টি
— “আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তারে আমি আপনায়…”
অতএব— আমাদের প্রিয় প্রাণের কবি নজরুলও বুঝিয়ে দিয়ে গ্যাছেন— নিজের ভিতরেই খুঁজতে হয় সেই আপনজনকে… আর এই খোঁজ ? অনন্ত কালের । জন্ম-জন্মান্তরে— এই খোঁজ চলতেই থাকে…আমরা কী আদৌ তাকে পাই কখনও ? না, সহজ নয় অত । শুধু হাতড়ে বেড়াই— অসীম থেকে অসীমে…
— যদি পাই কখনও অমূল্য সে রতন— তাই আশা ছাড়া আমি পছন্দ করিনা…প্রতি মুহূর্তে আমি আশা নিয়েই বাঁচি
— আশাই ভরসা— তবে, সে আশার বীজ নিজের ভিতরেই পোঁতা থাকে…তাই সেই আপনকে নিজের ভিতরেই খুঁজুন
— আপনি কী জানেন— আশার প্রদীপ জ্বলে ওঠে কখন…?
হঠাৎই আবার দমকা একটা ঝড়…!
কবির জানলার দিকে তাকালাম—কবি উঠে আসছেন দরজার কাছে…তবে কী কবি বুঝতে পেরেছেন, দরোজার বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে— কবি কী ডাকবেন ঘরে…পড়তে দেবেন কথোপকথনের আরও কিছু কথা…
( চলবে… )