#সঞ্চিত_অভিমান #শ্বেতা_ব্যানার্জী

#সঞ্চিত_অভিমান

#শ্বেতা_ব্যানার্জী

“ওগো দুখ জাগানিয়া ”
শুধু কবিতাকে ভালোবেসে তোমাকে এই খোলা চিঠি—
একবার কবিগুরু রাণুকে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন “….তোমার জীবনে, রাণু, যদি আমার সদর দরজাটা খুঁজে পেতে, খোলা আকাশের স্বাদ পেয়ে হয়তো খুশি হতে।”…..
আমি তো সেই খোলা দরজার খোঁজে আজীবন… তবুও সম্পদের খোঁজ আজও অজানাই।
….আমি বেদনার সাথে আপোষ করে গেয়ে উঠি,

…”আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইলো না কেহ”

আজ জমে থাকা কথারা পরিশ্রম বিমুখ,ঠোঁটের আগায় ঠুঁটো হয়ে আছে কতদিন…
তাই না বলা কথাগুলো আজ লিপিবদ্ধ করে নিলাম।
তোমার মধ্যে যে স্ফুরণ দেখেছিলাম.. যা’কে তুমি জোনাকি ভেবে বাবুই এর বাসায় বন্দী রেখেছিলে,আসলে সে তো ছিল নক্ষত্র ,হ্যাঁ আমার কাছে ধ্রুবতারা।
যা কে তুমি আকাশের না করে আপন মুঠোয় রেখে দিলে।
…তুমি একসময় ভালো গাইতে, লিখতে, কত কবিতা আজ তারা উলঙ্গ মন নিয়ে কোথায় হারিয়ে গেছে!!
কেন তোমার এ অনিহা!! কেন তাদের একটু আদরে রাখলে না!! সে কী অভিমান!? তুমি তো অভিযোগ করতে শেখনি,সে যে তোমার স্বভাববিরুদ্ধ।
….তাই,নিজেকে কষ্ট দিয়ে নিজের মেধা ও মননকে নিজ হাতে সমাধি দিলে ——-
খুব ইচ্ছে করে তোমার কবিতার পাতা হ’তে অথবা
কবিতা সাগরের ঢেউ হয়ে যখন খুশি আছড়ে পরতে….।
…না এ জন্মে বুঝি দোলনচাঁপার দোল দেখা হলোনা,
…দেখা হলোনা পূর্ণিমার পরিপূর্ণতা দিঘির বুকে।
তোমাকে কতটা ভালোবাসি এ কথাটা লিখতে বসে দেখলাম; না আমি একাই, একাকিত্ব আমার জীবন- শব্দের মাধুর্য, আর সেই কারণে তোমাকে
লেখা কথাগুলো অক্ষর হয়ে ফুটলো না।

—-আজ আমার বোগেনভিলিয়া বাগানবিলাস এক
অসুখী বিলাসিতা, তবুও প্রজাপতির রঙিন পাখার
আলো, গাছেদের গায়ে বাতাসের গায়ে পড়া আলিঙ্গন এইসব দেখে মন ভালো করি।
পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য, দিয়ে তোমাকে ছুঁয়েও আজ আমি বড্ড একা,আমার না বলা
ভালোবাসা, তারা কেন এসে রাতের বেলা কাঁদায়!!
রাত বাড়ে আর ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে আমার দীর্ঘ শত্রুতা, আমার কেন মনে হয়…

“বুঝি আমার ব্যথার আড়ালেতে দাঁড়িয়ে থাকো
ওগো দুখ জাগানিয়া “…….

…..রাত স্তব্ধ হয়ে আসে, আমি তোমার মনের মাধুর্যের সন্ধানে মাধুকরী প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলি।
তুমি একবার বলেছিলে প্রেম আছে কাব্যে, বিবাহ প্রথায় নয়।সমাজজীবনে, লোকাচারে কোথায় প্রেম!!
বেলা পড়ে আসে, মুঠো করে ধরে রাখি যতটা ধরে
রাখা যায়। মনের ডানা সে তো স্বাধীন, তবুও কেন আজ উড়তে চায়না! প্রকৃতির কাছেও সে পরাধীন!

যা-কিছু ভীষণ, এই নিখিলের অনন্ত মাঝে অস্তিত্বের মধ্যে যা একমাত্র মূল্যবান, তা’কে উপেক্ষা করি কী করে!! তুমি যে একটা সুর, একটা বর্ণগন্ধস্পর্শময় আবহাওয়া… একটা জীবন্ত উৎসব।
না, কোন তরুণ বিলাস নয়,শুধুই প্রত্যাখ্যান। ছন্দোবদ্ধ সংলাপ আজ মুমূর্ষু রুগীর মতন যন্ত্রণা কাতর। গ্রন্থি ছিঁড়ে গেলে শুকিয়ে যাওয়া তো ভবিতব্য।
রোমান্টিকতা আর বিষাদ,মানুষের জীবনে দ্রব হয়ে মিশে আছে। তাই দুটোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে মানুষকে যেতে হয়,কিন্তু তুমি যেন—
” মার্চেন্ট অব ভেনিসের “আ্যান্টনিও চরিত্র।
যে কিনা বলে উঠে ” In sooth I know not why I am so sad”
আত্মকরুণা নয় আত্মপরীক্ষা, আমি চাই সেই আত্মপরীক্ষায় তোমার আত্মপরিচিতি হো’ক।আমি বুঝি তোমার দুঃখসাধনার কারণ। যা- কিছ কবিতা নয়, তা থেকে মুক্তি দিতে হবে কবিতাকে।
কবিতা তো কয়েকটি শব্দের গুচ্ছ নয়,কবিতা চিত্রকলাও।
ধরো বোদলেয়ারের কথা, তাঁর কবিতা
ছবির ভাষায় সৃষ্টি করছেন, রঁদা,রুয়োর মতন শিল্পীরা। কবিতায় দুঃখ যেমন থাকবে, থাকবে রাষ্ট্রের কথা, থাকবে রোমান্টিকতাও…
রোমান্টিকতা, যা মানুষকে মুক্তি দান করে, যা মানুষের চিত্তবৃত্তি, মোটেই তা চিত্তবিকার নয়।এটা মানুষের মৌলিক অধিকার। এলিয়ট অথবা ভালেরি, কিম্বা আমাদের ভাস্কর চক্রবর্তী, বিনয় মজুমদার, প্রত্যেকের ভাষাব্যবহার ক্লাসিকধর্মী, তবুও কত রোমান্টিক।
রবীন্দ্রনাথ সৌন্দর্যের ধারণাকে মূর্ত করেছিলেন ঊর্বশীতে, যার নাচের ছন্দে পুরুষ রক্ত আত্মহারা।
আসলে ইন্দ্রিয়ে যখন আগুন ধরে তখন আমরা ঈশ্বরকে আলিঙ্গন করি। কবিরা তো পূণ্যবান,
তাঁদের উপাচারে তাঁরা উপাচার্য।
….বিবেকের চৈতন্য যাকে সৃষ্টি করে, বিশ্ববিধাতার সৃষ্টি এই জগৎ সংসারকে বদলিয়ে নয়, অনুভব করে।
কবিতা তো আসলে উদার রাজার সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে মুক্তি খুঁজে চলা..।
কবিতা তো কয়েকটি শব্দের বিনুনি নয়, এ-যে নিখিলবেদনাকে ধারণ করে।
রোমান্টিক বা ধ্রুপদী, আসলে কবিতা হ’লো–
চৈতন্য দিয়ে সৃষ্টি করে,সাধনা দিয়ে শোধন করা।
এই জগতে একমাত্র সাড়া দেয় হৃদয়, সে-ও তো ঈশ্বরের দান,যে দানে আমরা রাতের আলোয় সূর্য দেখি। যদি হৃদয়ের দরজা, জানলা বন্ধ রাখো
তবে ঈশ্বরের করুণা থেকে বঞ্চিত হ’বে।
খুলে দাও রুদ্ধদ্বার; বয়ে আসুক মুক্ত বাতাস…
কবিতার ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করুক আরও আরও বিশুদ্ধ কবিতা —-

তুমি বলেছিলে, পথ যখন চলতে শুরু করে তখন থেমে কী লাভ। কিন্তু আজ পথ দু’ভাগ হয়ে চলতে শুরু করেছে…
এই প্রসঙ্গে কবিRobert Frost একটা কবিতার কথা মনে পড়ছে… তার চারলাইন তোমাকে বলি।

The Road Not Taken

Two roads diverged in a yellow wood,
And sorry I could not travel both
And be one traveler, long I stood
And looked down one as far as I could
To where it bent in the undergrowth;

সত্যিই তো পথ যদি দু’ভাগ হয়ে যায়, আমার এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই, আমার ক্লান্তি এখন বিনোদন। আজ বুঝলাম প্রকৃতির মধ্যে থাকা আর প্রকৃতিকে হৃদয়ে বেঁধে রাখা এক নয়।
তবু কবিগুরুর সুরে বলি…
…..”ধায় যেন মন সকল ভালোবাসা, প্রভু, তোমার পানে,তোমার পানে, তোমার পানে।”
যেখানে কবিতা, তুমি, আর ঈশ্বর মিলেমিশে একাকার।
ইতি——
মৃণালিনী …

২২,১২,২০

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *