মেলা—(প্রবন্ধ ) —- মিলি মজুমদার

মেলা—(প্রবন্ধ )

মিলি মজুমদার

মেলা বলতে বুঝি মিলন ক্ষেত্র অর্থাৎ যেখানে সামাজিক বানিজ্যিক ও ধর্মীয় কারনে বহু মানুষ একত্রীত হয়ে থাকেন।সাময়িক সময় কাল ধরে সকল মানুষের মেল বন্ধন ঘটে মেলার উৎসব কে কেন্দ্র ক’রে।

বেশির ভাগ মেলার সঙ্গে গ্রামের মানুষের কৃষ্টি কুটিরশিল্প অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকে।জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানব জাতি একত্রিত হয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন মেলা প্রাঙ্গণে।সারা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন উৎসব পালনের মাধ্যমে মেলা বসে।
কুম্ভ মেলা গঙ্গাসাগর মেলা বিশ্ব বইমেলা ও বিভিন্ন উৎসব কে কেন্দ্র মেলা বসে নানান দেশে, রাজ্যে ও বিভিন্ন জেলায়।এর মধ্যে বেশ কয়েকটি মেলা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।তার মধ্যে বৃহৎ ও প্রসিদ্ধ মেলার একটি হোলো কুম্ভমেলা।


কুম্ভ মেলা উপলক্ষে ধর্মপ্রাণ মানুষ দলে দলে তীর্থভ্রমণ করতে আসেন। কথিত আছে যে সমুদ্র মন্থনের সময় যখন অমৃত উঠে এসেছিল দেবতাগণ তখন তা কুম্ভের মধ্যে ভরতি করে নিয়ে যাওয়ার সময় কিঞ্চিৎ অমৃত মর্তের চারটি জায়গায় পড়েছিল।বর্তমানে সেই চারটি জায়গাতেই কুম্ভ মেলা হয়।সেই চারটি জায়গা যথাক্রমে প্রয়াগ, উজ্জ্বয়নী,নাসিক ও হরিদ্বার।এই চারটি জায়গা ঘুরেফিরে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে মেলার জন্য। এই কুম্ভমেলা নদী কে কেন্দ্র করে হয়।নদী ও নদীর সঙ্গমে এই মেলা বসে কারণ এই মেলার বৈশিষ্ট ও আকর্ষণ হোলো পুন্যতিথিতে পুন্যস্নানে পুন্যলাভ করা।স্নানের মাধ্যমেই পুন্য লাভ করে হাজার হাজার পুর্নার্থী।সুর্য চন্দ্র বৃহস্পতির রাশিগত অবস্থান অনুযায়ী কুম্ভ মেলার সময় ও দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়।এই বৃহৎ মেলার পরেই নাম করতে হয় গঙ্গাসাগর মেলা।


সাগরদ্বীপ কোলকাতার থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান। গঙ্গা ও বঙ্গোপসাগরের মিলন স্থান হোলো গঙ্গাসাগর মেলার প্রাঙ্গণ।কথিত আছে সগর রাজার ষাটহাজার ছেলের প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য ভগীরথ কপিল মুনির শর্তপূর্ণ আদেশ অনুযায়ী দেবী গঙ্গাকে অাহ্বান জানান পূজা প্রার্থনার মাধ্যমে।ভগীরথের আহ্বানে সারা দিয়ে মা গঙ্গা নেমে আসেন তার পবিত্র জলরাশি নিয়ে এই ভূমিস্থলে।তাই গঙ্গার আরেক নাম ভাগীরথী।কপিল মুনির আশ্রমকে কেন্দ্র করে হয় পূজার্চনা।


বহু প্রচলিত একটা কথা সেই ছোটোবেলা থেকে আমরা শুনে আসছি “সব তীর্থ বারবার গঙ্গা সাগর একবার।” একবার গঙ্গাসাগর গিয়ে পুন্য অর্জন করলে যারা শাস্ত্র মতে পূজার্চনা নিয়ম করে পালন করতে পারেন না তাদের পুন্যিলাভ ঘটে।পৌষ সংক্রান্তির দিনে গঙ্গা সাগরের মিলন স্থলে পুন্যস্নান ক’রে মানুষ পুন্যলাভ করেন।প্রতি বছর মকর সংক্রান্তির দিনে গঙ্গাসাগর মেলা বসে। সাগর দ্বীপে নদীর মোহনায় মানুষ স্নান করেন ও কপিল মুনির মন্দিরে পূজো দেন। বেলাভূমি জুড়ে বসে নানান পন্য মনোহারী সামগ্রী।এই মেলার বড় আকর্ষণ নাগাসন্নাসী, প্রবল শীতে সারা শরীর বস্ত্রহীন , ভস্ম মেখে থাকেন হিমালয় থেকে আসা এই নাগাসন্নাসীরা।বহু আগে লট আট ঘাঁটের থেকে নৌকো করে কিছুটা জলপথ অতিক্রম করে তারপর স্থলপথে বাসে চেপে আসতে হোতো এই মেলায়।রাস্তাঘাট উন্নত ছিল না বাসের সংখ্যাও নগন্য।হোগলা পাতার ছাউনি ঘিরে ঘর, খোলা আকাশের নীচে অস্থায়ী কাঠের উনুন তৈরি করে রান্না খাওয়া আর হাড় হিম করা ঠান্ডাজলে শীতের মধ্যে স্নান করা।এখন অনেক বাস, গাড়ির ব্যাবস্থা হয়েছে।পথ ও হয়েছে মসৃণ।বিবর্তন ঘটেছে মন্দির, পূজার সামগ্রী ও পূজার সামগ্রী বেচাকেনার নিয়ম রীতির।

বিষয় বস্তুর উপর নির্ভর করে নানান বৈচিত্র ঘটে মেলার।অন্যান্য রাজ্য ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গেও এমন বহু মেলা হয় বিভিন্ন জেলায় ও বিভিন্ন প্রান্তরে।কম বেশি কুড়িটির মতো উল্লেখযোগ্য মেলা হয় এই রাজ্যে।রাঢ় বাংলার প্রধান উৎসব হোলো গাজনের মেলা।কথিত আছে যে সন্ন্যাসীরা উচ্চ গর্জনের স্বরে দেবাদিদেব মহাদেবের নামে জয়ধ্বনি দিতেন,এই গর্জন থেকেই নাকি গাজন কথার উৎপত্তি আবার অনেকের মতে গাঁ মানে গ্রাম ও জন মানে জনগণ সেই জন্য গাজনের মেলা বলা হয়। যাইহোক বাঁকুড়া জেলার সব চাইতে বড় উৎসব হোলো গাজন। এই মেলা শুরু হয় চৈত্র মাস থেকে। বেশ অনেক দিন ধরে চলে এই মেলা এবং এই মেলার সংখ্যা দেড়শোর উপরে হয় শুধু বাঁকুড়াতেই।তবে সব চেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম হোলো এক্তেশ্বরের শিব মন্দির কে কেন্দ্র করে যে মেলা বসে।পাথর দিয়ে নির্মিত এই মন্দির বহু পুরাতন।এই মন্দিরের ভেতরে চার কোনা সিড়িঁর কয়েক ধাপ নিচে শায়িত পাথরের তৈরি মূর্তিকে শায়িত শিব জ্ঞানে ভক্তগন আরাধনা ও পুজার্চনা করেন।বহু মানুষের সমাগমে মেলা হয় জমজমাট।
সব সম্প্রদায়ের মানুষ এই মেলায় অংশ গ্রহন করেন।ভক্তারা অর্থাৎ সন্নাসীরাও এখানে এসে সাধনা করেন।সন্নাসীদের এখানে ভক্তা বলা হয়ে থাকে।বহু আগে পাটস্নানের নিয়ম অনুসারে প্রধান ভক্তাকে অর্থাৎ সাধুকে পেঁরেক জাতীয় শলাকাবিদ্ধ পাটায় শায়িত অবস্থায় মন্দিরে আনা হোতো এবং তাকে দেবতারই অংশ জ্ঞানে পূজো করতো বিশেষ করে আদিবাসীরা। আগুনে ঝাঁপ দেওয়া বান ফোঁটানো ধারালো অস্ত্রের উপর হেঁটে যাওয়া শরীরের নানান জায়গায় জিহ্বা তে শলাক বিদ্ধ করা এই সব রেওয়াজ ছিল। এখন অবশ্য এই সব প্রশাসনের দ্বারা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

পৌষ মাসের সংক্রান্তি তে বীরভূম জেলার কেঁন্দুলি তে ও খুব বড় মেলা বসে যেটা জয়দেবের মেলা নামে বিখ্যাত।
কথিত আছে প্রতি বছর মকর সংক্রান্তি তে জয়দেব কাটোয়ার গঙ্গায় যেতেন পুন্যস্নান করতে। একবার তিনি ভীষণ ভাবে অসুস্থ হয়ে যান।শারিরীক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে গঙ্গাস্নান করা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে।ঘুমের মধ্যে জয়দেব স্বপ্নে দেখেন যে স্বয়ং মা গঙ্গা স্ব মহিমায় উজানে অজয় নদী তে এসে মিলিত হবেন ওঁনারই জন্য, যাতে ভক্ত জয়দেব নিকটবর্তী এই অজয় নদীতে পুন্যস্নান করতে পারেন।এই কাহিনীর উপর ভর করেই কেঁন্দুলিতে জয়দেবের স্মৃতির উদ্দেশে মকর সংক্রান্তি তে তর্পন উৎসর্গ করেন বাঙালিরা।বড় মেলা বসে ও বহু পুর্নার্থীর সমাগম হয়।এই মেলার সব থেকে বড় আকর্ষণ হোলো বাউল গান সারারাত ধরে বাউলগান কীর্তনের জমজমাট অনুষ্ঠান হয়।আর বিনা পয়সায় আখড়ায় ভক্তদের থাকা ও খাওয়ার সুন্দর ব্যাবস্থা থাকে।

মেলার কথা বলতে গেলে বীরভূমের শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলাও খুবই বৃহৎ আকারে হয়।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই মেলায় বিশেষ ভাবে।মহর্ষী দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর এই মেলা প্রবর্তন করেন।আগে ভুবনডাঙার মেলা বলতে এই মেলাকেই বোঝাতো। বিশ্বভারতীর সংলগ্নে এই পৌষ মেলা বসতো।সময়ের সাথে সাথে মেলার আকার ও স্থান পরিবর্তন হয়েছে।সাতই পৌষ মেলা শুরুর দিন নির্ধারণ হয় ও উপাসনার মাধ্যমে মেলার সূচনা হয়ে থাকে। এই মেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজ্য থেকে ও অন্যান্য দেশ থেকেও বহু মানুষের ও শিল্পীর সমাগম ঘটে।মেলায় নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বাউল গান হয়।এছাড়া বিভিন্ন রাজ্য থেকে কুটির শীল্প নানারকম হস্থ শীল্প এখানকার বিভিন্ন ষ্টলে পাওয়া যায়। মৃতশীল্প,চর্মশীল্প, পটের ছবি, ডোকরা, নানান রকম খেলনা একতারা বাঁশি ইত্যাদি এই মেলায় পাওয়া যায়।তাছাড়া নানা রকমারি খাবারের ষ্টল বসে।তারমধ্যে পিঠেপুলি বেশ আকর্ষণী।বহু মানুষের সমাগমে মেলার প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে আনন্দময়।

এছাড়া রথের মেলাও খুবই জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয়। ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গে এই মেলা ধুমধামের সাথে পালিত হয়।ভারতের
মধ্যে সবথেকে প্রসিদ্ধ রথযাত্রা হোলো পুরীর রথযাত্রা।আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষে এই রথযাত্রা শুরু হয়।তিনটি রথ সাজানো হয়।রথের নাম নন্দীঘোষ, দলদর্পন ও ,তালধ্বজা। নন্দীঘোষ রথে অবস্থান করেন জগন্নাথদেব ,এই রথে ষোলোটি চাকা থাকে প্রায় পয়তাল্লিশ ফুট উঁচু এই নন্দীঘোষ রথে চারটে ঘোড়া ও শঙ্খচূড়া নাগুনি নামে রশি থাকে। নন্দীঘোষ রথের চূড়াতে থাকে ত্রৈলোক্যমোহিনী ধ্বজা।লাল ও হলুদ রংয়ের কাপড় দিয়ে সাজানো হয়ে থাকে জগন্নাথদেবের এই রথ।দারুকা এই রথের প্রধান সারথী।জগন্নাথদেবের রথে সহযাত্রী থাকেন কৃষ্ণ,নরসিংহ, রাম, নারায়ণ, রুদ্র ও বীর হনুমান।
বলরামের দেবের রথের নাম তালধ্বজা।এই রথের উচ্চতা চুয়াল্লিশ ফুট এটি সাজানো হয় সবুজ ও লালা রংয়ের কাপড় দিয়ে।চৌদ্দটি চাকা ও চারটি ঘোড়া থাকে,উন্যানী নামের ধ্বজা থাকে রথের উপরে। বাসুকীনাগ নামের রশি থাকে এই রথে।তালধ্বজা রথের সারথীর নাম মাতালি।বলরাম দেবের এই রথের সহযাত্রী থাকেন অনেক দেবতা। এঁদের মধ্যে থাকেন কার্তিক, গনেশ,সর্বমঙ্গলা, মুক্তেশ্বর, মৃত্যুঞ্জয়।
সুভদ্রার রথের নাম দর্পদলন। এই রথ সাজানো হয় কালো ও লাল রংয়ের কাপড় দিয়ে। চারটি ঘোরা ও বারোটি চাকা থাকে।
দর্পদলন রথের মাথায় থাকে নদম্বিকা নামের ধ্বজা। অর্জুন এই রথের সারথী। স্বর্ণচূড়া নাগুনি এই রথের রশির নাম। এই রথে থাকেন,শ্যামাকালী, মঙ্গলা, চামুন্ডা, চন্ডী, বনদূর্গা, বিমলা, শুলিদূর্গা।
বলরাম ও বোন সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে জগন্নাথদেব মাসীর বাড়ি গুন্ডিচা যান।এই রথযাত্র্রার সাথেই শুরু হয় নানান জেলা ও রাজ্য জুড়ে অন্যান্য রথযাত্রা ও রথের মেলা। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হোলো শ্রীরাম পুরের মাহেশের রথযাত্রা , কোলকাতার ইস্কনের রথযাত্রা নদীয়ার মায়াপুরের রথযাত্রা,
মেদিনীপুরের মহিষাদল ও গুপ্তি পাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্র মঠের রথযাত্রা।বহু মানুষের সমাগমে ধুমধামের সাথে পালন করা হয় এই রথযাত্রা আর এই রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে মেলার আয়োজন হয়।পসরা সাজিয়ে বসে বিভিন্ন গ্রাম গঞ্জ থেকে আসা মানুষ।জমে ওঠে রথের মেলা।
মেলার কথা বলতে গেলে বলে শেষ করা যাবে বলে মনে হয় না।
এমনি ভাবে নানান বিষয় কে কেন্দ্র করে গোটা বিশ্ব জুড়ে মেলার উৎসব পালন হয়ে থাকে।
তবে এই সকল মেলা ছাড়াও বিশেষ মাত্রা পেয়েছে বই মেলা।জ্ঞানের আলোর বিকাশ ঘটাতে বই আমাদের কাছে খুরই গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। স্থানান্তর যোগ্য অক্ষর বা টাইপ উদ্ভাবনের পর থেকেই মানব জাতির শিক্ষার ও জ্ঞানের আলোর বিস্তার ঘটে আরো সহজ ভাবে।জার্মানিতে এক বিশিষ্ট ব্যক্তি গুটেনবার্গ প্রথম স্থানান্তরযোগ্য অক্ষর উদ্ভাবন করে সারা বিশ্বে আলোড়ন ঘটান। গোটা বিশ্ব জুড়ে মানব জাতির শিক্ষা সাংস্কৃতিক উপাদান হিসাবে জনপ্রিয়তা ও জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন ঘটে এই স্থানান্তরযোগ্য টাইপের মাধ্যমে।এই উদ্ভাবনের ফলে বইয়ের বিস্তৃতি ঘটে ,বই হয়ে ওঠে সহজলভ্য।বই মেলা দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বে অনন্যতা লাভ করেছে।আন্তর্জাতিক বইমেলা গোটা বিশ্বে বেশ অনেক গুলো হয়।এছাড়া নানান রাজ্য জেলায় জেলায় বই মেলা মহা সমারোহে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

এমনি ভাবে গোটা পৃথিবীর দেশ বিদেশ রাজ্য তথা জেলায় ও গ্রামে নানান স্থানে উৎসব পালনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে সাময়িক মিলন ক্ষেত্র—-

———————–

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *