ক্রিশমাস ইভ / বানী চন্দ দেব

ক্রিশমাস ইভ / বানী চন্দ দেব
—————————————-
সুমেধার বাড়িতে কথা হচ্ছিল, এলিজাবেট্টা, জেনি, নিকোলেইভভ, সমুদ্র, ম্যাক্স। বিষয়টা ছিল নিউ ইয়ার ইভ কোথায় কিভাবে কাটানো হবে? সমুদ্র বোস এক ডাচ বুড়োর বাড়িতে ভাড়া থাকে। সেই প্রস্তাবটা দিল তার ভাড়া বাড়িতে হোক। এরা ইতস্তত করছিলো। বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়তে আসা, এতসব অচেনা ছাত্র ছাত্রীদের পার্টির হুজ্জতি কি জানি বুড়ো রাজি হবে কিনা । সমুদ্র বললে, “বলে তো দেখি”। তা সে বললে একটু কিন্তু কিন্তু করেই। বুড়ো তো মহাখুশি।
– “আারে ইয়ংম্যান ডাকো তোমার বন্ধুদের। আহ্! কতবছর পরে আমার বাড়িতে ক্রিশমাস পার্টি হবে স্যামুড্র”।
সবাই তো অপ্রত্যাশিত এই খবর পেয়ে উল্লসিত হয়ে উঠলো। ভিন দেশ থেকে পড়তে আসা ছাত্রদল এদেশে এসে চেষ্টা করছে খাপ খাইয়ে নেওয়ার। ঘর ছাড়া, আপনজন ছাড়া, কেবল পড়াশোনা। মাঝেমধ্যে একজোট হয়ে একঘেয়েমি কাটানোর চেষ্টা। নইলে বড্ড কষ্টকর হয়ে পড়ে জীবন যাপন। । ২৫ শে ডিসেম্বর ওরা সবাই লাঞ্চ সেরে সমুদ্রের বাড়িতে হাজির। সুমেধা তার ঘর থেকে ময়দা মেখে এনেছে, সংগে আলুর দম। শুরু হলো রান্নার তোরজোড়। রাত ৯ টা নাগাদ ডিনার এবং অন্দর সজ্জা শেষ হলো। ডাচ বুড়োর নাম আন্দ্রেই, ফ্রান্সের এই ছোট্ট শহর গ্রেনোবেল এ তার ৪০ বছর হল বসবাস। বসবাস বললে ভুল বলা হয়, কারণ বছর ১০ এক আগে অব্দি তো তিনি আর্মিতেই চাকরি করেছেন। কর্মসূত্রে গ্রেনোবেলে এসে মারিয়ানার প্রেমে পড়লেন, বিয়ে করলেন তাকেই, তারপর বিরাট এক বাড়িও করে ফেললেন। বাড়ির পিছনের জমিতে ফলের বাগান, কত যে ফলের গাছ। অবসর গ্রহণ করে জ্যাম জেলি বানানো তার নেশা হয়ে দাঁড়ালো
বেসমেন্টে সেসব সারা বছর মজুদ থাকে। ফরাসি মারিয়ানা সরকারি হাসপাতালের ওটি নার্স। আন্দ্রেই এর অবসরের দু বছর পর তার অবসর মিললো। মনোমালিন্য চলছিলো বেশ কিছুকাল ধরেই। এবার তা দানা বাঁধলো। আন্দ্রেই আর চেষ্টা করে নি। সম্পর্কে ইতি টেনে মারিয়া গ্রেনোবেলের ই আরেক প্রান্তে বাড়ি কিনে চলে গেল। সেখানে সে বহাল তবিয়তে আছে। দুজনের কেউই আর বিয়ে করেন নি। বাগানের ফল পাকলে মারিয়া তার হিস্যা বুঝে নিয়ে যান।বেসমেন্ট ছাড়াও আরও ৯ খানা ঘর বাড়িটিতে আছে। বেসমেন্টে সাজানো ছোট্ট একটা সুন্দর লাইব্রেরি আছে। ওখানে বুড়োর দিনের অনেকখানি সময় কেটে যায়। গ্রাউন্ড ফ্লোরে তিনটি ঘরে ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসা তিন ছাত্র ভাড়া থাকে। দোতলায় বাড়িওয়ালা স্বয়ং থাকেন। দোতলার আরেকটি ঘরে তার এক ভাগ্নী থাকে, সেও পড়ুয়া। আর আছে এক কালো বেড়াল মিশা, সে কেবল ঘুমায়।
আন্দ্রেই একে একে সকলের সাথে পরিচয় করে নিয়ে নিজের বানানো বিরাট কেক কেটে পার্টি শুরু করলেন। চললো নাচ। সমুদ্র সুমেধার দিকে তাকিয়ে বললে,
– বুড়ো হাড়ের ভেল্কি দেখ।
সত্যি তিনি বেশ ভালো নাচেন। আফ্রিকান পল যোগ দিলো খানিক পর। সে তার দেশীয় কি এক খাবার এনেছে যেন। সুমেধার তো একটুও ভালো লাগলো না। তবে তার লুচি আলুর দম দারুণ হিট করে গেছে। ভাগ্নী নিকিতার আপেল টার্ট বেশ ভালো খেলো সবাই। সারাদিন প্রচুর খাটুনি গেছে। নাচ, গান, খাওয়ার পর বুড়ো তো কাউকেই ছাড়লেন না অত রাতে। সুমেধা তো জোর একচোট ঘুমিয়ে নিল।উঠতেও বেলা হলো। বুড়োর আবদারে এ বেলাটাও ওখানেই কাটাতে হলো। সবাই মিলে রান্না শুরু হলো আবার। খাবার টেবিলে বসে তিনি অনেক দেশের গল্প শোনালেন। সংগে নিজের হাতে বানানো জ্যাম জেলির উপাদেয় স্বাদ থেকেও বঞ্চিত করলেন না তাদের। তার নিঃসংগ প্রাসাদে কি যে বসন্তের হাওয়া বইছে, তা তিনি যেন মন প্রাণ দিয়ে উপভোগ করে নিতে চাইছেন। কর্মসূত্রে তাকে অনেক দেশ ঘুরতে হয়েছে, বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরা তার ঝুলি।সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– ইন্ডিয়াতেও গেছি হে।
বিদায় বেলায় দেশ ছাড়া লোকটির মন যেন ব্যথাতুর হয়ে উঠলো। স্মিত হেসে বললেন,
– ইয়াং গাইস, আবার পার্টি হলে আমায় ভুলোনা যেন, চলে এসো। ঘুম কাতুরে বেড়ালটা এক চোখ খুলে একটু দেখে নিলো। বাগানের আইভিলতাও যেন দুলে উঠে সেকথাকেই স্বাগত জানালো।

*

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *