সুবর্ণরেখার পারে— কোয়েলী ঘোষ
এই যাত্রাপথে কোয়েলীর সাথে
এই পথে তুমিও সঙ্গী হতে পার
যতখানি প্রসারিত করো মন
এসো , সেই সুন্দরের খোঁজে যাই
নদীর স্রোতে জীবন প্রবাহে ,
কান পাতি অরণ্য ভাষায় , নিস্তব্ধতায় ।
শীতের কুয়াশা এক ভোরে আমরা একদল ভ্রমণপিপাসু মানুষ চলেছি মহানন্দে , যেখানে সুবর্ণরেখা নদী বয়ে যায় কলরবে , বুকে জেগে থাকে কালো শিলা , সবুজ অরণ্য ঘিরে থাকে , জলপ্রপাতের শব্দ ঝরে নিস্তব্ধ পাহাড়ের কোলে , লাল মাটির পথ এঁকে বেঁকে চলে যায় কোথায় …সেখানে এক উদাসী লিখে রাখেন উপন্যাস , গল্প —সেই মাটি আর পৃথিবীর টানে চলেছি ঝমঝম শব্দে সরীসৃপযানে ।
হাওড়া স্টেশন এসে ছটা পঞ্চান্ন ইস্পাত এক্সপ্রেস ধরেছি । ট্রেনে এক বাউল অপূর্ব গান শুনিয়েছে । খড়গপুর স্টেশনে টিফিন সারা হল । তারপর ঝাড়গ্রাম পেরিয়ে এক শান্ত নির্জন স্টেশনে এসে নামলাম তখন বেলা প্রায় সাড়ে দশটা বাজে ।
স্টেশনের নাম ঘাটশিলা , কলকাতা থেকে ২১৪ কিলোমিটার দূরে ঝাড়খন্ডে পূর্ব সিংভূম জেলার একটি ছোট্ট শহর । নাম না জানা বুনো ফুল ফুটে আছে অজস্র ।
স্টেশনের সামনে অনেক অটো দাঁড়িয়ে । কাছেই আমাদের হোটেল স্নেহলতা লজ আগেই বুক করা ছিল । নিজেদের ব্যাগ রেখে স্নান করে সামনের হোটেলেই খাওয়া দাওয়া সেরে নিই । তারপর ঘরে এসে একটু বিশ্রাম নিই ।
বিকেল তিনটে নাগাদ ভাড়া করা হলো তিনটি অটো । তারপর বড় রাস্তা থেকে বাঁদিকে মাটির মোরাম বিছানো পথে ঢুকে পড়ল । পথটির নাম অপুর পথ । একটু পরে এসে পৌঁছলাম সেই
বাড়ির সামনে , গেটের ওপরে লেখা আছে গৌরীকুঞ্জ , প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ি ।
সবুজ রঙের গেট দিয়ে ঢুকে সামনে সবুজ ঘাস বিছানো জায়গা , তুলসী মঞ্চ , সামনে তারাদাস মঞ্চ ।
বাঁদিকে লেখকের মূর্তি স্থাপিত আছে ।
নতশিরে প্রণাম জানিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম । পাশাপাশি দুটি ঘরে লেখকের বই আলমারিতে সাজানো আছে । নিজের হাতের লেখা চিঠি , পুরনো ছবি , ব্যবহৃত পোশাক সযত্নে রক্ষিত আছে । বাংলায় লেখা একটি দেওয়াল পত্রিকা দেখলাম ।
পুরনো তুলসীমঞ্চটি এখনও আছে । আগে একটি ভাঙা বাড়ি ছিল । ঝাড়খণ্ড সরকার পরে বাড়িটির সংস্কার করেন । পুরনো বাড়ির ছবি সংরক্ষণ করা আছে ।
যাঁরা দায়িত্বে রয়েছেন তাঁরা বললেন বাংলা ভাষা কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমরা একটি আন্দোলন করছি । আদিবাসী ছেলেমেয়েদের বাংলা পড়ানো হয় সেজন্য কিছু অর্থদান করে যাবেন । সেইমত কিছু অর্থ দান হল । বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অজানা গল্প বলতে শুরু করেছেন এক দাদা ।
১৯৫০ সালের ১লা নভেম্বর এই বাড়িতেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন । প্রকৃতিকে এতো নিবিড় করে উপলব্ধি করে , মানুষকে ভালোবেসে , বাস্তব জীবনের অনুভূতিকে, যিনি তাঁর সাহিত্যে এক অনেক বড় পটভূমিতে নিয়ে গেছেন , যেখানে দেশ কাল সময়ের সীমা পেরিয়ে গেছে অনায়াসে । সেই স্রষ্টার মূর্তির দিকে তাকিয়ে , তাঁর বাড়িতে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত এক আত্মীয়তা অনুভব করেছিলাম প্রিয় সাহিত্যিকের সাথে ।
প্রকৃতির টানেই ঘাটশিলায় বানিয়েছিলেন এই ঘর গৌরীকুঞ্জ “- তাঁর প্রথমা স্ত্রী গৌরী দেবীর নামে । যাঁকে তিনি বিয়ের এক বছর পরেই হারিয়েছিলেন ।
টোটো এবার এসে দাঁড়াল রামকৃষ্ণ মিশনের গেটে । ফুলে ফুলে সাজানো আশ্রমটি যেন শান্তি নীড় । এখানে বেশ কিছু সময় বসেছিলাম ।
তারপর আবার যাত্রা শুরু হল সুবর্ণরেখা নদী তীরে ।
চলবে ..