## ভূতের গল্প : ## গল্পের নাম : ইরাবতী ## কলমে : মালা মুখোপাধ্যায়

## ভূতের গল্প :

## গল্পের নাম : ইরাবতী

## কলমে : মালা মুখোপাধ্যায়

–এই যে শুনুন, আপনি ঘোরাফেরা করছেন কেন? অনেক রাত হয়েছে।যান ,যান বলছি নিজের বেডে।

রামকৃষ্ণ সেবা প্রতিষ্ঠান হাসপাতালের দোতলায় এক সিস্টার রীতিমত ধমক দিয়ে ৮০ নং বেডের পেশেন্টকে পাঠিয়ে দেন।
খাতায় টিক মারতে মারতে বলেন , এখন রাত প্রায় একটা। কখন লাইট অফ করে দেওয়া হয়েছে। উনি এখন চাঁদের রূপ দেখতে বেরিয়েছেন। বলিহারি সব আজকালকার মেয়েরা।
কোথায় নিজের সন্তানের কাছে থাকবে , না বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
রমাদিদিমনি সব থেকে সিনিয়র।আজ তিনদিন পর জয়েন করেছেন। ছুটিতে ছিলেন। ইমারজেন্সি ঘরের সামনে। ওঁনার ডিউটি। উনি ফোনের কাছে। অফিস দেখছেন। আর একজন সিস্টার বয়স কম , তাঁর ডিউটি ইমারজেন্সি ঘরে। প্রতিটি পেশেন্টকে অপারেশন ঘর থেকে এনে এখানে রেখে দেওয়া হয়েছে। রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠান। সারারাত এখানে সিস্টার জেগে থাকেন। ডাক্তাররাও। একটু গড়িয়ে নেওয়ার জন্য পাঁচ মিনিট সময়ও থাকে না। নিখুঁত লক্ষ্য। খুঁত বিহীন চিকিৎসা। হয়তো বড়ো বড়ো নামজাদা হাসপাতালের মতো ঝাঁ চকচকে নয়। কিন্তু খুব যত্নসহকারে পেশেন্টকে দেখেন। একটা নিয়ম শৃঙ্খলা আছে,যা খুব কম জায়গায় দেখা যায়।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আবার দেখেন সেই পেশেন্ট। একটু মায়া হলো। একটু কৌতূহল হলো। রমাদি তাকে এবার না বকে স্নেহের সঙ্গে বললেন,মা ঘুম আসছে না? কি অসুবিধা হচ্ছে আমাকে বলো? বেবিকে ফিডিং করাতে পারছো তো?
–হ্যাঁ, আমার তো এটা দ্বিতীয় বাচ্চা। কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
–আমি না আর শ্বশুরবাড়ি যেতে চাই না। একটু ইতস্তত করে বলে। বলবো কি বলবো না ভেবেও বলে দেয়।
–ওমা সে কি? কেন? যাবে কোথায়?
চাকরি করো? রীতিমত অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন। মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হয়ে যান। আজকালকার মেয়েদের নিয়ে আর পারা যায় না। কী কেলো রে বাবা ! সদ্যজাত শিশু নিয়ে ভাবছেন, শ্বশুর বাড়ি যাবেন না। পাগল নাকি?
–না । আমি চাকরি করি না। আমার শ্বশুর বাড়ি খুব বড়লোক।
–তবে অসুবিধাটা কোথায়?বেশ গম্ভীর হয়ে বলে বলেন।
–আমার স্বামী একমাত্র সন্তান। আর আমার প্রথমে মেয়ে হয়েছে।
–তো?
–আবার এবারেও মেয়ে হয়েছে।
–তো?
–আমাদের সবাই খুব আশা করেছিল , এবার আমার ছেলে হবে।
–আশা করলেই কি হয়? ঘ্যান ঘ্যান করো না। আমার অনেক কাজ আছে। এসব তোমাদের ঘোড়া রোগ। সুখে খেতে ভূতে কিলায় ,বোঝো তো? যত সব। তুমিও আশা করতে ? তোমার ছেলে হবে?
— একদম। আশা করবো না? মেয়ের পর ছেলে কে না চায় বলুন তো?
— চাইলেই কি পাবে তুমি? পেলে কি?
— না, জানেন তো, যে দেখতো, সেই বলতো, আমার নাকি পেটটা সামনের দিকে এগিয়ে। উঁচু। পিছন থেকে কিছুই বোঝা যায় না।
–বুঝলাম। তাতে তোমরাও দায়ী। বলতে পারো না? জোর গলায় , আমার সন্তান হবে। কিসের ভয়? এই সুখ স্বাছন্দ্যের ভয়? এই বাড়ি গাড়ি ভোগ করার মোহ?
— না ,না , আপনি এতোটা রাগবেন না। একটু আমার কথাটা শুনুন। আগেরবার আমি খুব মোটা হয়েছিলাম। পেট ছিল গোল। যে দেখতো বলতো ,মেয়ে হবে। হলো তাই।
—তোমরা থাকো কোথায়? আরো বিরক্ত হয়ে বলেন।
—টালিগঞ্জে।
—কলকাতায়, এই যুগে , এই রকম ভাবনা? আমি ভাবতে পারছি না। তোমরা শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এই ব্যাপারটাকে এতো গুরুত্ব কেনো দিচ্ছো? খাতায় মন দিয়ে কাজ করতে করতে ভ্রুটা কুঁচকে তোলেন।
–হ্যাঁ । অনেকেই বলছিল ,প্রথম মেয়ে হলে ক্ষতি নেই। প্রথম মেয়ে হলে বাপের পরমায়ু বাড়ে।
–আর দ্বিতীয় মেয়ে হলে তো শুনেছি মায়ের পরমায়ু বাড়ে। জানো তো সেটা? হাতের খাতাটা সরিয়ে রেখে আর একটা খাতা খোলেন। খাতার দিকে তাকিয়ে বলেন, পুত্র হবে ছেলে হবে,এটা কিন্তু মেয়েরাই বেশি চায়। হয়তো পুরুষ সন্তান চেয়ে ,সংসারে ক্ষমতা প্রয়োগের বাসনায়।
–না, না। তা না ব্যাপারটা। বিশাল সম্পত্তি। একটা ছেলে না থাকলে বংশের প্রদীপ জ্বালবে কে? এই কারখানা দেখবে কে?
–জামাই দেখবে। মেয়েকে মানুষ করবে। হেরে গিয়ে পিছিয়ে যাবে,এটা তো কাজের কথা নয়।
–আমিও সেই কথাটাই বলেছিলাম জানেন। তার উত্তরে আমার স্বামী বলেছিল ,জম -জামাই-ভাগ্নে —তিন নয় আপনে।
—বাঃ ভালো মিলিয়ে বলেছেন তো আপনার স্বামী।
–আমার স্বামীর নিজের কথা নয়। ডাক পুরুষের কথা। আমিও খুব ঠাকুর ব্রত করলাম , আমি ভাবছিলাম, এবার আমার ছেলে হবেই। কিন্তু হলো না। শ্বশুর বাড়ির লোকে খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন।
—হয়েছেন তো —, তাতে তোমার কি? পিছন ফিরে বেশি করে ভাত খাবে। লাউ খাবে। ফল খাবে। পেট ভরে মেয়েটাকে বুকের দুধ খাওয়াবে। মায়ের দুধের গুন জানো না? যতসব ফালতু।
তারপর কি জানি , একটু মায়া হলো,আহা বয়স তো বেশি নয়। একটু ভালোবাসা , একটু সাপোর্ট চাইছে হয়তো। তাছাড়া সবার নার্ভের জোর তো সমান হয় না। হয়তো একমাত্র মেয়ে। তসু। আমাদের মতো কি আর দশ ভাই বোন ? তাই একটু নরম সুরে বলেন,
মা, তুমি ওদের কথা ভেবো না ‌। তুমি কি জানো ? জানা উচিত ছেলে হবে না মেয়ে হবে, সবকিছু নির্ভর করছে তোমার স্বামীর ওপর। তোমার ওপর নির্ভর করে না। এই কারণে আবহকাল ধরে মেয়েরা সংসারে লাঞ্ছিত হয়ে আসছে। কিন্তু কখনও আঙুল তুলে বলতে পারে নি, সন্তান পুত্র হবে না কন্যা তা একটা মেয়ের উপর নির্ভর করে না। যাক , ছেড়ে দাও। তুমি অনেকটা আমার মেয়ের মতো।
নিজের শরীরের কথা ভাবো। শিরদাঁড়া সোজা হয়ে দাঁড়াও। আর চোখ বুঁজে ভাবো তো একবার, তুমি মেয়ে, আমি মেয়ে, মেয়ে ছাড়া জগৎ সংসার চলে নাকি? ওরা তোমার রত্ন। তোমাকে ,বুঝলে ? তোমাকে সবার আগে রিয়ালাইজ করতে হবে। তুমি সন্তান চেয়েছো। সুষ্ঠু ভাবে পৃথিবীর আলো দেখেছে। এবার তাকে পরম ভালোবাসায় বড়ো করো।
এবার একটু রেগে গিয়ে বলেন,একটা কাজ অনেকেই করে ,দেখেছি , ছোটো মেয়েকে ছেলেদের পোশাক পরিয়ে বড়ো করে। তারপর তার বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেয়। কিছু বলার নেই। আমার উপর তো আর নেই ভূবনের ভার। কবিগুরুর কথা।
যাও গিয়ে এবার নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ো। আমার অনেক কাজ বাকি।
–খুব শান্তি পেলাম। কেন জানি না আমার মনে হচ্ছিল , আপনাকে বললে একটু শান্তি পাবো। মনের মধ্যে একটা জোর পাচ্ছি। কেন যে কয়েকদিন আগে দেখা পেলাম না । আক্ষেপটা থেকে গেল।
— এখন তো পেলে। এবার বলো,তোমার নাম কি ?
–আমার নাম ইরাবতী। সবাই ইরা বলে।
–যাও। মেয়েকে দ্যাখো। ঘুমিয়ে পড়বে কিন্তু।কপট গম্ভীর হয়ে বলেন। যদিও মনটা একটু ভারাক্রান্ত হয়ে যায়, সমাজের এই লিঙ্গ বৈষম্য ব্যাপারটার জন্য। কবে যে মানুষ মানুষ হবে!

একটু পরেই ইমারজেন্সি ঘর থেকে আর এক সিস্টার এসে বলে,দু’দিন আগের একটা ঘটনা তোমাকে বলা হয় নি। তুমি তো ডিউটিতে ছিলে না।
–কি হয়েছে?
— জানো, কি বলবো তোমাকে? সে এক কান্ড গো।
–কি ? তাড়াতাড়ি বল । হাতে অনেক কাজ পড়ে আছে। এর আবার একটু ভণিতা করা স্বভাব, মনে মনে ভাবে।মাঝে মাঝে তিলকেও তাল করে।
–একটা পেশেন্টকে সিজারের পর ইমারজেন্সি তে দিয়েছে। এমনিতে সব ঠিক ছিল। হঠাৎ করে কোমায় চলে যায়। ডাক্তার এসে খুব নাম ধরে জোরে জোরে ডাকছেন। নড়িয়ে নড়িয়ে ডাকছেন। যাতে কোমায় না যায়। আর অদ্ভূত ব্যাপার , মেয়েটির দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে । তারপর ধীরে ধীরে বলছে , আমি বাড়ি যেতে চাই না।এ মুখ আমি দেখাতে চাই না।
–তারপর? খাতার দিকে কাজ করতে করতে বলেন।
–আমার দিকে তাকাও না, পরে কাজ করবে। একটুও বাড়াচ্ছি না গো।ডাক্তারবাবু তখন খুব ঝাঁকিয়ে বলেন,জেগে থাকো। জেগে থাকো। মেয়ে হয়েছে তো কি হয়েছে? হায়! তাও শেষ রক্ষা হলো না।
–মরে গেল? মরে গেল!
গলার স্বরটা একটু নরম করে বলেন ,জানিস, একটু আগে , এই যাস্ট তোর আসার আগে,আমার কাছেও একজন এই রকম বলছিল,তার অবশ্য এটি দ্বিতীয় কন্যা।
–এরও দ্বিতীয় কন্যা গো।
–কি নাম? বেড নং কত?
–বেড নং ৮০, নাম ইরাবতী। ডাক্তারবাবু বলছিলেন ,ইরা –,ইরা –, যাঃ,স্যাড।
–কি আবোল তাবোল বলছিস? তোর না স্বভাব গেলো না।তিলকে তাল করার। এইমাত্র আমার কাছে ইরাবতী এসেছিল। বেড নং ৮০, ইরা বলে সবাই ডাকে। কত কথা বললাম !
–তুমি কি পাগল হয়েছো? এই দ্যাখো ,এই দ্যাখো , খাতা দ্যাখো। কি দেখছো?
–ইরাবতী ,বেড নং ৮০, বিড় বিড় করে বলতে বলতে , ধীরে ধীরে চেয়ারে বসে পড়েন। হাতলটা চেপে ধরে বলেন, একটু আগে আমি যে ইরাবতীর সঙ্গে কথা বললাম। কত কথা ! এও কি সম্ভব?
হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া বয়ে যায়।
দমকা মানে দমকা বাতাস। ঘুরপাক খেতে খেতে টেবিলের কাগজ গুলো লন্ডভন্ড করে পাশের চেয়ারটা উল্টে দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

আরো অবিশ্বাস্য ভাবে , ইরাবতী নাম লেখা পাতাটা খাতা থেকে খুলে গিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ওরা দু’জনে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাতাটা আর পেলো না।

২৯.১১.২০২০.
৪ পি.এম.
ত্রিবেণী, হুগলী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *