শ্রদ্ধাঞ্জলী —– সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
[ কিছু কথা:— প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র ও নাট্যব্যক্তিত্ব তথা বিশিষ্ট কবি ও আবৃত্তিকার,স্বর্গীয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মরণে, আন্তরিক শোক ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে সামান্য কিছু কথা আলোকপাত করছি।]
” কার্তিকের ভোর নাকি ভিজে থাকে শিশিরের জলে—” সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
আজ দুপুরে ( 15.11.2020. Sunday.২৯শে কার্তিক ১৪২৭বঙ্গাব্দ।) হেমন্তের আকাশে মুখরিত হলো, এক মোহনীয় বাঁশির সুর, সে এক ব্যক্তিত্বশালীর সুর-ঐশ্বর্যে! রূপ-রস-গন্ধে মাতাল হলো আকাশ-বাতাস! আমরা শুনি উনারই কথায়——
“যদি বলে যেতে নাই পারি
এইখানে খুঁজে দেখো
হয়তো বা রয়ে গেল সম্ভাষণ
বিদায়ের, প্রণয়ের ও——-”
——-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
আজ রাস্তায় জনপ্লাবন, চারিদিকে জনরোল ,
সবার দীর্ঘ শ্বাসে শব্দরাও বড্ড চঞ্চল।
যাত্রার পথ হয়তো খুব দীর্ঘ নয় ,
কিছুক্ষণ পরেই হবে সব শেষ
সবাই ফিরেও আসবে নিজের সীমানায়;
যেখানে এতোটা বছরের অভিজ্ঞতাকে
সব ধূঁমজালে আবিষ্ট হতে দেখবে ।
———-স্বপ্না ধরচৌধুরী ।
অশ্রু সিক্ত নয়নে ,নিজের অস্তিত্বকে হয়তো আর অনুভব করতে পারবে না ; সবাই বলবে তখন, সব মিথ্যে সব মিথ্যে!
এ হিমেল হাওয়া মনকে উদাস করে তুলবে , বৈরাগী হবে মন!
এক অমোঘ সত্য কে উপলব্ধি করবে , এ সংসার তুচ্ছ ও নিমিত্ত মাত্র মনে হবে ,তাই “গীতা”র কথাতেই বলি:–
” ইহৈব তৈর্জিতঃ সর্গো যেষাং সাম্যে স্থিতং মনঃ।
নির্দোষং হি সমং ব্রহ্ম তম্মাদ্ ব্রহ্মণি তে স্হিতাঃ।।”
( যাঁদের মন সাম্যে অবস্থিত হয়েছে, তাঁরা ইহলোকেই জন্ম ও মৃত্যুর সংসার জয় করেছেন। তাঁরা ব্রহ্মের মতো নির্দোষ, তাই তাঁরা ব্রহ্মের মতো নির্দোষ, তাই তাঁরা ব্রহ্মেই অবস্থিত হয়ে আছেন।)
তারপর সম্বিত যখন ফিরবে ,দেখবে বাস্তবের অমোঘ রূঢ়তাকে, আবারও চেনা শহরের অবিন্যস্ত জীবন-যাত্রায় আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে। এটাই চরম সত্য! আর এ সত্যকে নিয়েই সাগরের উচ্ছ্বাসের তরঙ্গে তরঙ্গে পাঁক খেতে থাকবে ।শ্বাস রুদ্ধ হবে ,বুকের ভেতরটা ও খালি হতে থাকবে ,সব শূন্য শূন্য লাগবে ,তবুও আবারও চলবে চলবে —–!
আজ রাস্তায় খুব ভিড় এ হেমন্তের দুপুরে। কবি নিজে ও বলেছেন:—
” অনেক গুলো রাস্তা বন্ধ
অনেক গুলোতেই দু’দিক দিয়ে গাড়ির লাইন
পা রাখব কোথায়——–“( সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।)
জনতার কৌতূহল, জনতার দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে, স্মৃতিরা খুব ফিরে ফিরে আসছে, হ্যাঁ সুখ-স্মৃতিরা ফুলকির মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে! এমন বিষন্ন দুপুর , সবাইকে বিপন্ন করে তুলছে !
কবির ( সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)কবিতায় পেলাম,—-
” মধ্যরাত্রির এক একটি ঘুমন্ত গ্রামের মত
অকাতর স্বপ্ন গুলি
এখন নেই।”
আমি তাই বলছি, তুমি বাস্তব, দিনের আলোকে প্রস্ফুটিত ‘লাল গোলাপ’ , তোমার সৌন্দর্য্য , রূপে-গুণে; তাই—
” মধুঋতুর আগুন পাহাড়ে পাহাড়ে মালা হয়ে জ্বলে।” –সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
হে প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র ও নাট্যব্যক্তিত্ব, তোমার জন্যে চাই ,
“বৈদুর্যমণির সিংহাসন।”–সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । আমরা তোমার জন্যে চাই , তোমারি কথায় ,” আকাশের মঞ্চ!”
তোমার “ঠোঁটের অলৌকিক হাসি”( সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) , সবাইকে মুগ্ধ করেছে, আমরা আপ্লুত তোমার কবিতা ও আবৃত্তিতে । আমরা সবাই দিলাম, স্নিগ্ধ জোৎস্নার কোমল দ্যুতিময় আলোক, এতেই তুমি ভূষিত হও -প্লাবিত হও আপন ভূষণে! যেখানে জীর্ণতা নেই ,
আছে শুধু —
” সলিলের তলে জলধির আসল হৃদয়।” —( সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।)
তোমার কবিতায় কবিতায় আমার সারাটা দিন কেটে গেলো , গভীর বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা হয়তো বিধাতা দেন নি , কিন্তু তোমাকে অনুভব করলাম। কিছুটা হয়তো বুঝলাম, যেখানে তুমি বলেছো, ” সহজের মাঝে অনিবার্য দুঃখগুলি মেশা মেশি করে আছে ——।” জীবনের তাৎপর্যকে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করলাম। সুখের প্রকৃত সংজ্ঞা হয়না, তাই দুঃখকে পাশা পাশি সাজালাম, কিছু টা অনুভব করলাম , সুখ-দুঃখের।
সন্ধে হয়ে এলো , বটবৃক্ষে, পাখীরা ওদের বাসায় ফিরে আসছে । কিচিরমিচির শব্দের সাথে শঙ্খধ্বনি ও ঘন্টা ধ্বনি মনটাকে আরও আবিষ্ট করে তুলছে। ভাবছি পাখীদের কথা কেমন একটা সুসম্পর্ক ওরা গড়ে তুলেছে, বটবৃক্ষ, তোমার সাথে ।তেমনি তোমার বিশাল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে জনগণের গাঁট-ছড়ার মতো একটা বন্ধন তৈরি হয়ে গেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ বন্ধন অন্তরের-হৃদয়ের।
হে কবি ! তোমার কাজের বিশালতায় আমরাও নিজেকে জড়িয়ে নিলাম আজ। আমরা তোমার জন্যে গর্বিত! তবে হিমালয়ের মতো এমন বিশালত্বশালী শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে হারিয়ে আজ আমরা গভীরভাবে শোকাহত ও মর্মাহত!
এখন আমাদের মন ভালো নেই। মনের মধ্যে সাগরের ঢেউ মালা আছড়ে পড়ছে সজোরে, তাই শুনছি সেই শব্দ, যেনো কবি তুমি এখন ও বলছো , ———–
” মনের মধ্যে হাল ধরে কেউ আছে যাত্রী,
তাদের ভাঙলো না কি জোড়। ”
সবার তরফ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই তোমাকে।
আবারও কবি তোমার কথাতেই শেষ করছি :———-
” সে এখন থাক
এসো আর একবার কুশলের বিনিময় করি
হয়ত এ ভাবেও নতুন দৃশ্যের অবতারণা করা যেতে পারে —–
এসো শুধু বলি
কেমন, খবর সব ভালো
ভালো আছো ?” — সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।