গল্প : “পেয়িং গেস্ট” কলমে : রাজ দত্তগুপ্ত
গল্প : “পেয়িং গেস্ট”
কলমে : রাজ দত্তগুপ্ত
পাঁচদিন পরে অফিস-ট্যুর থেকে ফিরতে বাড়ির দক্ষিণ দিকের গেস্ট হাউসে আলো জ্বলতে দেখে অমিত একটু অবাকই হয় । অহেতুক কৌতুহল প্রকাশ করা অমিতের স্বভাব নয়, নিশ্চয়ই কেউ এসেছে । মার কাছেই সব জানা যাবে । অমিত এখনো বিয়ে করেনি, বিয়ে করার ইচ্ছা তার নেই । বিয়ের বয়স তার অনেকদিন আগেই হয়ে গেছে । চাকরি আর ছবি আঁকা নিয়ে তার সারাদিন কেটে যায়, আর বিধবা মায়ের সেবা করা । সুলতা দেবী অনেক বুঝিয়েছে ছেলেকে, কিন্তু অমিত রাজি না । তার মনে হয় বৌ এলে মার স্নেহ থেকে সে বঞ্চিত হবে । সে তো ভালোই আছে ।
কলিং বেলটা বাজতেই সুলতা দেবী দরজা খুলে ছেলেকে বুকে জরিয়ে আদর করলেন । অমিত মাকে প্রণাম করল । ছোটো দু-একটি কথা বলে অমিত ফ্রেশ হতে গেল । সুলতাদেবী চা, জলখাবার করতে গেলেন । খাবার টেবিলে বসে অমিত মার কাছে জানতে চাইল, গেস্ট হাউসে কেউ এসেছে নাকি, কারণ সে ঢোকার মুখে দেখেছে যে ওখানে আলো জ্বলছে । সুলতাদেবী একটু হেসে বললেন, ‘হ্যা রে খোকা, গত পরশু দিন থেকে একটি অবিবাহিত মেয়ে এখানে পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকছে । তোর রমা মাসীমার দাদার মেয়ে । রমাদি আমাকে অনেকদিন থেকে বলছিল । মেয়েটির বাড়ি ব্যান্ডেলে । মেয়েটি লেক টাউনে একটা অফিসে চাকরি করে, ওই যে রে সুমনদের অফিসে । ব্যান্ডেল থেকে যাতায়াতে ভীষণ অসুবিধা হচ্ছিল মেয়েটির, তাই রমাদির কথা ফেলতে পারলাম না’ । আর তাছাড়া, সবদিক দেখে মেয়েটিকে বেশ ভালো লাগলো । তোর কোনো আপত্তি নেই তো?
— না না মামণি, আপত্তি হবে কেন? ভালোই তো হল । তোমার একজন সাথীও হল….
— না রে খোকা, রিণি অফিস থেকে এসে একেবারেই বেরোয় না । মাঝে সাঝে ফোনে কথা হয় । একদিন তো বললাম, অফিস থেকে ফিরে কি কর, একটু আসতে তো পারো মাসীমার কাছে । উত্তরে কি বলল জানিস ?
— কি?
— মাসীমা, নিশ্চয়ই যাবো আপনার কাছে । সবে তো এলাম আপনাদের বাড়িতে । আসলে আমার খুব বই পড়ার নেশা । বাড়ি ফিরে টুকটাক কাজ সেরে আমি বই নিয়ে বসে যাই । নিশ্চয়ই যাবো….
— ভালো । আচ্ছা মামনি, আমি ল্যাবে গেলাম ।
— আর তাছাড়া, ঘরে কেউ থাকলে ঘরটার ও যত্ন হয় । এইসব ভেবে….
— ঠিক আছে মামনি….
অমিত কিছু ভাবতে ভাবতে ওর ল্যাবের দিকে পা বাড়ায় ।
পরের দিন অমিত অফিসে যাবার মুখে দেখল, গেস্ট হাউসের বাইরে থেকে তালা দেওয়া । বুঝল, রিণি আগেই অফিসে বেরিয়ে গেছে । সন্ধ্যার সময়ে অফিস-ফেরত অমিত দেখল, গেস্ট হাউসে আলো জ্বলছে । অমিত বাড়ির দিকে পা বাড়ায়…
মামনির সাথে খাবার টেবিলে গল্প করে অমিত তার ল্যাবের দিকে পা বাড়াতেই সুলতা দেবী ছেলেকে ডাকলেন ।
— হ্যা বল মামনি ?
— খোকা, আমার একটা কাজ করে দে না
— বল….
— রিণির একটা চিঠি এসেছে । দিয়ে আসবি খোকা?
— আচ্ছা দাও
নির্লিপ্তভাবে চিঠিটা হাতে নিয়ে অমিত গেস্ট হাউসের দরজায় বেল বাজাতেই ভিতর থেকে প্রশ্ন এলো, ‘কে ?’ ।
— আমি অমিত । দরজাটা খুলবেন?
— দরজা খোলা আছে । চলে আসুন ।
— ও আচ্ছা…
দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে অমিত কাউকে দেখতে পেল না । বসার ঘরে একটা ডিম লাইট জ্বলছে । অমিত প্রশ্ন করল, ‘আপনি কোথায়?’
— কেন? কিছু দরকার আছে কি?
— না মানে, আপনার একটা চিঠি এসেছে । মামনি পাঠিয়ে দিলেন ।
— রেখে যান টেবিলে । আমি একটু ব্যাস্ত আছি । মাসীমাকে আমার প্রণাম দেবেন
ঘরের ভিতর থেকে উত্তরটা আসার পরে অমিত চিঠিটা যথাস্থানে রেখে গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে একটু চিন্তিতমনে ঘরে ফিরল ।
বেশ কয়েকদিন কেটে গেল । কিছুদিন পরে একদিন সন্ধ্যায়, অমিত অফিস থেকে ফিরে চা জলখাবার খেতে বসেছে । সুলতাদেবী একটা কথা বলে ফেললেন ।
— খোকা একটা কাজ করে দিবি আমার?
— এভাবে বলছ কেন মামনি ?
— না এমনি রে…
— বল
— মাটন-বিরিয়ানি তৈরী করেছি । একটু রিণির ঘরে দিয়ে আসবি?
অমিত কিছুটা ইতস্তত করে, কারণ সেদিনের চিঠি দেবার কথা মনে পড়ে গেল, তাও মার অনুরোধ, অগত্যা…
— দাও
সুলতা দেবী সুন্দর একটি কেরিয়ারের মধ্যে খাবারটি ভালো করে সাজিয়ে দিয়ে অমিতের হাতে ধরিয়ে দিলেন । অমিত গেস্ট হাউসের দিকে এগোলো ।
অমিত আর আজকে কলিং বেল বাজালো না । দরজা ঠেলতেই খুলে গেল । ড্রইং রুমে ডিম লাইট জ্বলছে । বিশাল রুমের উত্তরের জানালার দিকে পিছন ফিরে রিণি বসে আছে বাগানের দিকে চেয়ে । অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছে । সামান্য ঠান্ডা হাওয়ার আমেজ সে উপভোগ করছে। অমিতের উপস্থিতি, মনে হল না রিণি বুঝতে পেরেছে । অমিত দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল—
— ভিতরে আসতে পারি?
মুখ না ঘুরিয়েই রিণি বলল—
— আসুন
— মামনি আপনার জন্য একটু খাবার পাঠিয়েছেন । প্লিজ….
— উঃ সত্যি, মাসীমা কি যে করেন না!
বলতে বলতে রিণি ঘুরে দাঁড়িয়ে দুটো লাইট জ্বালিয়ে অমিতের দিকে এগিয়ে এল । অমিত খাবারটা রেখে পিছন ফিরে চলে যাচ্ছিল । হঠাৎ কি মনে করে ঘুরে দাঁড়াল । ভূল দেখছে না তো অমিত?
— একি, রঞ্জিতা……তুমি?
— চিনতে পারলে তাহলে ! আমি কিন্তু অনেকদিন আগেই তোমাকে চিনে নিয়েছি । রোজ তোমাকে দেখি যখন অফিস থেকে ফেরো । কিন্তু আলাপ করবার সাহস আমার হয়নি ।
— কেন?
— নিজেকে জিজ্ঞাসা কর ।
— কি বলছ তুমি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না ।
— ঠিক, স্বাভাবিক । না বোঝাটাই ভালো।
— মানে?
— মনে পরে সে দিনের কথা? আমার তখন ভীষণ আর্থিক অনটন চলছে । কোথাও কোনো চাকরি হচ্ছে না । চারদিকে চেষ্টা করছি । সেই সময় কোনো সুত্রে তোমার কাছে এলাম । তুমি আমাকে প্রায় ঘন্টা তিনেক বসিয়ে আমার ছবি আঁকলে ।
— হ্যাঁ কিন্তু…..
— তুমি আমাকে ভালো পেমেন্ট দিয়েছিলে ঠিক, কিন্তু আমার মনটা তোমাকে দিয়ে ফেলেছিলাম । সেটাই বোধহয় আমার ভূল । আর তারপরে তুমিও আমাকে কোনো দিন ডাকোনি অমিত
— তুমি….আমাকে…..
— অনেক খুঁজেছি তোমাকে অমিত । অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি । কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি….. তবু ভালো, আজ চিনতে পারলে ।
কি উত্তর দেবে অমিত ভেবে পায় না । হঠাত্ রিণির হাতটা ধরে অমিত বলে উঠল—
— এসো
— কোথায়?
সুলতাদবী অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন ছেলের জন্য । এতো দেরি কেন হচ্ছে খোকার ? কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুলতেই অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন সুলতাদেবী দুজনের দিকে । অমিত হঠাত্ বলে ফেলল—
— রিণিকে নিয়ে এলাম মামনি। তুমি যেন কি বলছিলে? হ্যাঁ, এখন তুমি আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারো।
সুলতা দেবী কিছুই বুঝতে পারলেন না, শুধু আনন্দে তিনি আঁচলে চোখ মুছলেন।
•••••••••••••••••