স্বপ্ন-সাম্পান ( ২ ) —-//ঋদ্ধি ঘোষ
স্বপ্ন-সাম্পান ( ২ )
———————————
—-//ঋদ্ধি ঘোষ
ঝড় ক্রমশ পাকিয়ে ধরছে । তাপ তো নেই এই নরম ভোরে, তবুও ধাতুর মতো বুকের ভাঁজে গলে যাচ্ছে নিষেধের শৃঙ্খল !
‘অনিদ্রা’ লেখা নীল খামের ভিতর থেকে, বেরোতে চাইছে সফেদ সমুদ্র-ফেনার বুদবুদ। কতবার এই ফেনাতেই মিশে যেতে দেখেছি ‘অভিসার’ শব্দটাকে !
আমার বুকে যে পালক উড়ে এসেছিল সেদিন, তাকে কেউ মিথ্যুক বেইমান মীরজাফর ব’লে ছুঁড়ে দিয়েছে ঝড়ের এই এলোমেলো ভোরে । অথচ আমি জানি আলোরা চিরকালই তাদের লোমশ বুক পেতে দ্যায়, অন্ধকারে পিষে ফ্যালা ক্ষুধার্ত জমিতে । তাই স্বপ্নরাও কখনও আরশি নদীকে সাক্ষী রেখে, নরম প্রজাপতির কপালে সুখের তিলক এঁকে যায় । লাঙলের ফালে সব ছিন্ন হবে জেনেও, স্বপ্নের ঘড়াতে ভর্তি জল রাখে। তৃষ্ণার্ত কাক পাকস্থলীর ব্যাধি ভুলে ইতিহাস লিখবে ব’লে।
জানি সত্যের আকাশে অবসাদ থাকে না । রূপশালী ধানের বীজ পুঁতে দিই তাই অনাবাদী মাটিতেও । সাধন কিনা জানিনা, হয়তো আমাদের কখনও কখনও শব্দহীন ক’রে তোলে সময় । আর সে সময়ের আঙুলে অনুভবের সুতোর গিঁট বেঁধে দেখেছি– নীলকন্ঠ পাখি এলেই, আকাশ কেমন আপন শরৎ হ’য়ে ওঠে ! ফুটন্ত রূপশালীর ভাতে সুগন্ধ ছড়ায় বুক-উঠোনের বাতাস…!
ঝড় ক্রমাগত উড়োনচন্ডী, তছনছ । ভেঙে দিতে চায় সব… ছোবলে ছোবলে নীল করতে চায় লখিন্দরের বাসর । কিন্তু এ বিষের দহনের জ্বালাকে ভয় পেয়ে আগুনকে উদ্বাস্তু করিনি কখনও । বরং পিঁড়ি পেতে দিয়েছি বুকের চৌকাঠে।
এই রে, আমার ঐ এক স্বভাব খেই হারানো । কিন্তু জানো, সেদিনের স্বপ্নে খেই হারালেই, কবি যেন কী অদ্ভুতভাবে সুতোটা ধরে দিচ্ছিলেন !
মনে পড়ে গ্যালো আমার তো পড়াই হয় নি বাকি পাতাগুলো । কবির ফুলের বাগান এই ঝড়ের ভোরে, কখন যে নদী হ’য়ে গ্যাছে বুঝতেই পারিনি । আর আমি সেই নদীতে পানসি ভাসিয়ে, তীরে দাঁড়িয়ে দেখছি ভাবনারা কেমন দুলতে দুলতে ভেসে যাচ্ছে দূরে– সোনালী জলে আল্পনা এঁকে …!
কবির কাছে সৃষ্টি মানেই তো, তার সন্তান। আর সেই সন্তান যদি এমন ঝড়ের ভোরে হারিয়ে যায়, তবে তা অসহ্য যন্ত্রণার…
দেখছি, কবি সন্তানহারা পিতার মতো পাগল হ’য়ে ছুটে আসছেন । আমি তা দেখেই, গাছের পাশে আড়াল হলাম । কারণ তার লেখা ঐ পাতাগুলো পড়বার লোভও আমি ছাড়তে পারিনি ।
ঝড়ের দাপটে উড়ে যাওয়ার ভয়ে আঙুলের ফাঁকে খুব করে চেপে ধরলাম । চোখের সামনে পরের পাতাটা খুলে ধরতেই, মনে পড়ল আবার ‘কথোপকথনে’র বড় প্রিয় সেই দু’লাইন—-,
“তোমার মধ্যে অনন্তকাল বসবাসের ইচ্ছে
তোমার মধ্যেই জমিজমা, ঘরবাড়ি…”
আবার ভেসে গেলাম । আসলে ভাবনারা মাটিধোয়া কাঠামোর মতো । স্রোতের দিকে ভেসে গিয়েই সুখ তার…
না, এবার সত্যিই কবির হাতে ধরা পড়বার ভয় আছে । ধরা পড়ে গেলেই, ছুঁয়ে দ্যাখা হবে না দুধের সরের নীচে শুয়ে থাকা শান্ত শব্দকণাদের…
— কী করছেন জানতে পারি ?
— আচ্ছা, আপনি কী তসলিমা নাসরিনের লেখা পড়েন ?
— বলুন না, ব্যাস্ত আছেন নাকি
এই লাইনগুলো পড়তে পড়তে হঠাৎই মনে পড়ল—,
” মাথায় বাগান খোঁপা, খোঁপায় হিরের প্রজাপতি…”
আরে এ কী —! যদিও আমার মা বলে, আমার সিক্স সেন্স ছোটো থেকেই বেশি । তাইবলে স্বপ্নতেও এই বেশি’র নমুনা.. !
জয় বাবা ভোলেনাথ…!
কবির লেখা ঐ কবিতার লাইনে খোঁপার কথা ভাবতেই, কবির এ লেখাতেও, খোঁপার মানুষের ধৈর্য্য চ্যুতি ঘটল। অবশেষে তাকে এত এত মেসেজের উত্তর দিতেই হল…
— হ্যাঁ , বলুন
— বলব । আগে ওষুধ খেয়ে আসি
— আচ্ছা
— আপনাকে অনেকবার ফোন করছিলাম । হয়তো নেটওয়ার্ক প্রবলেম । অনেকক্ষণ পরে ফোন লাগলো, যখন আপনি ব্যস্ত
— ও… আচ্ছা
— আমি অপেক্ষা করছি, আপনার কথা শেষ হ’য়ে গেলে জানাবেন…
( ক্রমশ…)