পান্না হলো সবুজ——–কাজরী বসু

পান্না হলো সবুজ

কাজরী বসু
(পর্ব ২)

….ভিতরে আসুন,প্লিজ।
সাদা রঙের একটা ফুল হাতা টপ আর হলদে লঙ স্কার্ট পরে রয়েছে তিস্তা। ওর বয়েস ঠিক কত? কুড়ি একুশের আশেপাশেই হবে।

বসার ঘরে নিচু লেদার কাউচ, বেশ আধুনিক ডিজাইনের, তিস্তা বলল,বসুন প্লিজ। আমি একটু আসছি।

বেশ বড়ো বড়ো জানলা রয়েছে ঘরে, গাঢ় বাদামি মোটা পর্দা দুদিকে রিবন দিয়ে আটকানো,ফলে ঘরে বেশ হালকা রোদের আলো খেলা করে বেড়াচ্ছে। সামনের দেয়ালে কাচ বাঁধানো দুটি অয়েল পেন্টিং, কাউচের চারপাশে চারটি বড়ো বড়ো বাঁকুড়ার ঘোড়া। টেবিলের উপর একটি ইনডোর প্ল্যান্ট। ডানদিকের দেয়াল জুড়ে কাচের শো কেস, বাঁ দিকে অন্য ঘরে যাবার দরজার পাশে বেশ বড়ো একটি ওয়াল হ্যাঙ্গিং।

ট্রেতে করে নিজেই সফট ড্রিঙ্কসের গ্লাস এনেছে তিস্তা।
সঙ্গে স্লাইস কেক একটা,প্লেটে।
…নিন,একটু খান,এতটা পথ এলেন…
…আপনি কি এ ফ্ল্যাটে একাই থাকেন?
….মানি এই সময় দোকানে যায়। বাপি মারা যাবার পরে মানিকেই দোকানের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। এই সময়টায় আমি একা থাকি,তাই আপনাকে এই সময়টাই দিয়েছি। আসলে মানি থাকলে তো করা যাবে না কাজটা, মানি তো আসলে জানেইনা..

আমি ভাবছিলাম,মেয়েটা আশ্চর্য রকমের ডেসপারেট তো!
একা একটি তরুণী, আমার মতো একজন যুবককে দিব্যি ডেকে পাঠালো,আমার মনে তো কোনো খারাপ উদ্দেশ্যও থাকতে পারে…

মোবাইল বাজছে তিস্তার।
হ্যালো, হ্যাঁ তিস্তা বলছি..
তিস্তা উঠে ভিতরে গেল ফোনে কথা বলতে বলতে।

ঘরটা একটু ঘুরে দেখতে উঠে দাঁড়ালাম। আমার পিছনের দেয়ালে তিস্তার একটি আলোকচিত্র, এতক্ষণ পিছনে থাকায় চোখে পড়েনি। তিস্তা একটি সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে, ফুল হাতা সাদা জামা আর সাদা পাজামা ধরনের পোশাক পরনে, কোমরে একটি কালো রিবন টাইট করে বাঁধা। ছবিটি একটাই কথা বলছে,তিস্তা মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণের যে ধাপ পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে ফার্স্ট ডান ব্ল্যাক বেল্ট বলে। আর সেই
পর্যন্ত পৌঁছনোর অর্থ, নিজের নিরাপত্তার জন্য সে একাই একশো, কাউকে ভয় পাওয়ার প্রয়োজন নেই তার।

এবারে বুঝলাম তার সাহস আর আত্মবিশ্বাসের আসল কারণ।

তিস্তা আমায় ইমপ্রেস করতে শুরু করেছে ততক্ষণে।

..কি দেখছেন?
চমকে তাকালাম। হাসিমুখে তিস্তা দাঁড়িয়ে।
.. আসুন,আমরা কাজের কথাগুলো বলে নিই। আপনি বলুন আমায় কি কি জিজ্ঞাস্য আছে আপনার।
নরম পানীয়র গ্লাস ঠোঁটে ছুঁইয়ে বললাম,
..আপনার বাবা স্টোনগুলো বাড়িতেই রেখেছেন না অন্য কোথাও সে বিষয়ে আপনার কাছে কি কি তথ্য আছে?

… তথ্য বলতে, দেখুন, উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পরে আমি কর্ণাটকের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়াশোনা করছি। এ বছরই আমার ফাইনাল ইয়ার। একটা সেমেস্টার কমপ্লিট হবার মধ্যিখানের ছুটিতে আমার বাড়ি আসা। কলেজে ভর্তির পর পরই বাপির ক্যানসার ডিটেক্ট হয়। সেই সময় ফোনেই কথা হতো বেশি। বাপি আমায় একদিন বলে,তোর জন্য কিছু জেম আমি বাড়িতে কোনো একটা জায়গায় রেখে যাব। তুই পেয়ে যাবি, কোথায় রাখছি সেটা ফোনে বলা ঠিক হবে না। তবে বাড়িতেই রাখব,এটা নিশ্চিত। পরে সময়মতো তোকে বলে দেব।

…”আচ্ছা,একটা কথা বলুন তো,আপনার মাসিকে মানে মানিকে কি আপনার বাপি সন্দেহ করতেন?

…. সন্দেহ ঠিক নয়… মানি কিন্তু আমাকে খুবই ভালোবাসে। মায়ের অসুস্থতার সময় থেকে মানি ই তো আমায় কোলে পিঠে করে বড়ো করে। আর সেই কারণেই আমার কথা ভেবে এই স্যাক্রিফাইস। তাই আমার কোনো ক্ষতি মানির তরফ থেকে হবেই না, বাপিও সে কথা জানত।

…কিন্তু সেক্ষেত্রে এই লুকিয়েচুরিয়ে আপনার জন্য কিছু রেখে যাওয়া,ব্যাপারটা একটু কেমন না? মনে হচ্ছে না কারো কাছ থেকে আপনার বাবা এই পাথরগুলোকে আড়াল করতে চাইছিলেন,যাতে আপনার জিনিস সুরক্ষিত থাকে! আপনি নিজেই ভাবুন না। এটা কি স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে আপনার? এত লুকোছাপা কার জন্য?

না, বলছি আপনাকে, ব্যাপারটা আসলে..
আই মিন..

কথার মধ্যে তিস্তার মোবাইল বেজে উঠল। “এক্সকিউজ মি” বলে ফোন নিয়ে উঠে পাশের ঘরে চলে গেল তিস্তা।

আমি উঠে পায়চারি করতে লাগলাম। এই ফ্ল্যাটের মধ্যে কোথায় কয়েকটা মূল্যবান পাথর সযত্নে লুকিয়ে রেখে গেছেন অনন্ত সোম তা আমায় খুঁজে বের করতে হবে। ক্লু হিসেবে আপাতত কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। ঘরের অন্যদিকেও কয়েকটা সোফা কাউচ ছড়ানোছিটোনো। ছোট্ট একটা নিচু ডিভানে পাঁচ ছটা সফট টয়। কোনোটা টেডি বিয়ার,কোনোটা কুকুর,কোনোটা শিম্পাঞ্জি। একটা বিশাল বড়ো পেঁচাও আছে।

….”আপনি খোঁজার কাজটা কাল থেকে শুরু করে দিন,”কখন যেন তিস্তা এসে দাঁড়িয়েছে,” রোজ বারোটা থেকে চারটে অবধি সময় পাবেন। তারপর আপনাকে চলে যেতে হবে। মানি এসে পড়বে। মানির কাছে বাপি যখন ব্যাপারটা বলেইনি,তখন আমিও সেটা জানাতে চাই না। আমি আর দিন পনেরো থাকব,তারপর আমার ক্লাস শুরু হয়ে যাবে,আমি ফিরে যাব হোস্টেলে। আপনি এই কয়েকটা দিন খুঁজে দেখুন। পাথরগুলো এই বাড়িতেই আছে। কোথায় আছে তা বের করার দায়িত্ব আপনার।”

লিফট দিয়ে নেমে ফ্ল্যাটের পিছন দিকটাই আগে পড়ে। এদিকটায় অনেক গাছাগাছালি। গেটের দিকে যেতে গিয়েও পিছন দিকটায় এগিয়ে গেলাম। উপরে পাঁচতলায় তিস্তাদের জানালাটা বন্ধ। জানি না এখনো ওটা কার ঘর। নীচে কয়েকটা ফাঁকা টব রাখা আছে। মনে হয় গাছ লাগাবে বলে কেউ কিনেও আর লাগায়নি। একটা টবের মধ্যে কয়েকটা কাগজের টুকরো। বেশ কিছুদিন বৃষ্টি বলে কিছুই নেই, মনে হয় তাই শুকনো রয়েছে। কিছুই না হয়তো, তবু অভ্যেসবশে তুলে নিয়ে পকেটে চালান করে দিলাম।

বাড়ি এসে প্রথমেই পকেট থেকে বের করলাম কাগজগুলো। পরিষ্কার হাতের লেখায় কিছু কিছু কথা লেখা আছে।
একটায় লেখা,

কোথায় গেল নখ?
ভেজাস না আর চোখ!

আর একটায় লেখা,

সব কি থাকে কন্যে
শুধুই দেখার জন্যে!
মন না দিলে আমার কথায়
খুঁজবি হয়ে হন্যে!

তাজ্জব ব্যাপার! এ তো বেশ দু চার লাইনের ছড়া দেখি! ছড়া লিখেছে বুঝলাম। কিন্তু যেই লিখুক, সে লিখে জানলা দিয়ে বাইরে কেন ফেলেছে! কেন!

(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *