তীর্থের পথে পথে — কেরালা পদ্মনাভ স্বামী মন্দির—- কোয়েলী ঘোষ
তীর্থের পথে পথে — কেরালা
পদ্মনাভ স্বামী মন্দির
কোয়েলী ঘোষ
“তোমাদের তরে স্বর্গের দ্বার খুলে
আলোর প্রহরী আজো অপেক্ষমান
নিঝুম স্বর্গ তোমরা জাগাবে জীবনের বেদ পাঠে
মহাকারণের শয়ন ছাড়িয়া জাগিবেন আঁখি মেলি
মানুষের ভগবান । ”
কন্যাকুমারী থেকে খুব সকালে বাসে আমরা চলেছি —গন্তব্যস্থল কেরালার তিরুবন্তপুরম । সেখানেই আছে বিখ্যাত প্রাচীন এক মন্দির পদ্মনাভ স্বামী মন্দির । কেরল ও দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত হয় এই মন্দির ।
কেরলের রাজধানী শহর তিরুবন্তপুরমে বাস এসে দাঁড়াল । বাসষ্ট্যান্ড থেকে নেমে মন্দিরের পথে হাঁটতে শুরু করলাম । কর্তা মশায়ের এক কেরালিয়ান বন্ধু মন্দিরের সামনে দেখা করতে এসেছেন । তাই তাড়াতাড়ি পা চালাতে হল । দুদিকে বড় বড় দোকান পাট , বেশি সোনার দোকান চোখে পড়ল । এখানে মহিলারা জিনিস পরে ঘুরে বেড়ান ।
দূর থেকে মন্দির দেখা গেল আর বন্ধু দাঁড়িয়ে ছিলেন হাস্য মুখে । দেখা হতেই জড়িয়ে ধরলেন বন্ধুকে ।
সামনে মন্দির ।দুদিকে শাড়ি ধুতির দোকান আর , নানারকম পুজোর সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে ।
এখানে নিয়ম ছেলেরা ধুতি আর মহিলারা শাড়ি পরে মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবেন ।
অনেকে এখানে ধুতি কিনছেন । অগত্যা তিনিও একটি ধুতি কিনে পড়লেন ।
বন্ধু বললেন আমাদের মন্দির ঘুরে আসতে আর তিনি ততক্ষণ একটু বাজার ঘুরে আসবেন ।
বেশ কিছু সিঁড়ি পেরিয়ে মন্দিরের প্রবেশ পথ ।
তিরুবানন্তপূরম কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল ভগবান অনন্ত পদ্মনাভস্বামী । এখানে ভগবান শ্রীবিষ্ণু অনন্ত নাগের ওপর শয়ন করে আছেন ।
খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর ইতিহাস এখানে লুকিয়ে আছে । ভগবান বিষ্ণুর ১০৮ টি পবিত্র মন্দিরের মধ্যে এটি অন্যতম ।
এই মন্দিরটির উল্লেখ পুরাণে পাওয়া যায়, যেমন, স্কন্দ পুরাণ , পদ্ম পুরাণ , মৎস পুরাণ , বরাহ পুরাণ এবং মহাভারতের মত ধর্মগ্রন্থে ।
মন্দিরটি পবিত্র পুকুর পদ্মতীর্থম এর পাশেই অবস্থিত ।
১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে ট্রাবাঙ্করের রাজা মার্তন্ড বর্মা এই মন্দির সংস্করণ করেন । তিনি এই রাজ্যকে ভগবান পদ্মনাভের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন এবং নিজেকে ঈশ্বরের দাস বলে শপথ নেন । সেইজন্য পরবর্তী কালে সমস্ত রাজাদের নামের আগে পদ্মনাভ দাস লেখা হয় ।
বর্তমানে মন্দিরটি ত্রাভাংকোরের রাজপরিবারের নেতৃত্বে একটি অছিপরিষদ দ্বারা পরিচালিত হয়।
শ্রীপদ্মনাভস্বামী মন্দিরের দেবমুর্তিটি এর গঠন শৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ, যার মধ্যে রয়েছে ১২০০৮ টি শালগ্রাম শিলা । নেপালের গন্ডকী নদীর তীর থেকে সেই শিল।গ্রাম নিয়ে আসা হয়েছিল।
লাইন আস্তে আস্তে এগিয়ে চলে আর পৌঁছে যাই
শ্রীপদ্মনাভীস্বামী মন্দিরের গর্ভগৃহের সামনে । ভেতরে অন্ধকারে তেলের প্রদীপ জ্বলছে ।
পর পর তিনটি দরজা দিয়ে দর্শন করলাম । একটি পাথরের বেদীর ওপর শ্রীবিষ্ণু শায়িত আছেন
মস্তক থেকে বক্ষ অবধি প্রথম দরজা দিয়ে, হস্তগুলি দ্বিতীয় দরজা দিয়ে এবং পদযুগল তৃতীয় দরজা দিয়ে দর্শন করলাম । দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত , নাভী থেকে একটি পদ্ম উঠেছে , এবং সবশেষে দুখানি শ্রী চরণ ।
মন্দিরের স্থাপত্য পাথর এবং ব্রোঞ্জের । মন্দিরের দেওয়ালে খোদাই সুন্দর চিত্রকর্ম এবং ম্যুরাল যেখানে আছে অর্ধশায়িত অবস্থায় ভগবান বিষ্ণুর মুর্তি, নরসিংহ স্বামী , গনপতি দেব এবং গজলক্ষ্মী দেবী।
মন্দিরের ৮০ ফুট উচ্চতার ধ্বজ স্তম্ভটি সোনার জল করা রূপোর পাত দিয়ে মোড়া।
এই মন্দিরে মধ্যে রয়েছে বালি পীডা মন্ডপম এবং মুখ মন্ডপম। বিভিন্ন হিন্দু দেবদেবীর মুর্তিদিয়ে কারুকার্য করা হল-ঘর। আরেকটি আকর্ষক স্থাপত্য হল নবগ্রহ মন্ডপ। যার ভিতরের ছাদে নবগ্রহের ছবি আছে।
পূর্বদিক থেকে পবিত্রবেদী অবধি বারান্দায় পাথর-খোদাই করা স্থাপত্য সহ গ্রানাইট পাথরের থাম রয়েছে। পূর্বদিকের মূল প্রবেশ দ্বারের নীচে একটি গ্রাউন্ড ফ্লোর রয়েছে , সেটিকে নাট্যমঞ্চ বলা হয় যেখানে দশদিন ব্যাপী বাৎসরিক উৎসবে কেরলের শাস্ত্রীয় নৃত্য-কথাকলি অনুষ্ঠিত হয় ।
এই মন্দির নিয়ে অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে । এখানে লুকানো আছে রাজার গুপ্তধন , যার একটি দরজা এখনো খোলা সম্ভব হয় নি ।
দর্শন আর প্রণাম শেষে বেরিয়ে এসে দেখি বন্ধু দাঁড়িয়ে আছেন । ব্যাগ থেকে উঁকি দিচ্ছে নানারকম ফুল । শুনলাম তাঁর স্ত্রীর জন্য নিয়ে যাচ্ছেন । তিনি ফুল দিয়ে বোকে বানাবেন ।
তারপর একটি অটো করে চলে আসি বাসষ্ট্যান্ড । সেখানে বন্ধুর অনুরোধে এক গ্লাস ফলের রস খেলাম । নানারকম ফল দিয়ে তৈরি , যার মধ্যে পাকা কলা ছিল ।
বন্ধুর কাছে বিদায় নিয়ে বাসে ফিরে আসা আর দুপুরের খাওয়া সেরে আবার যাত্রা শুরু হল কেরালার অপূর্ব সৈকতভূমি কোভালামের উদ্দেশ্যে ।
দুটি চোখ বন্ধ রাখি
দুটি চোখ মেলে থাকি —
মাঝে মাঝে অন্তরের ঝাঁপি খুলে দেখি
রূপে অরুপে অপরূপ তুমি !
বাজে কোথাও সেই অনন্ত অশ্রুত গান ।