কথা দিয়েছিলাম ——– বিক্রম ঘোষ
কথা দিয়েছিলাম
বিক্রম ঘোষ
পর্ব – ৫ (অন্তিম পর্ব)
অবশেষে এল সেই দিন। সবার মিলিত প্রচেষ্টায় পত্রিকা টাঙানো হলো দেওয়ালে। সবার চোখে মুখে খুশি যেন উপছে পড়ছে। সৃষ্টি সুখের আনন্দে। সবার মধ্যে কণিকাকে অন্যরকম লাগছিল বিমলের, খুশি হয়েও যেন খুশি নয়। কারণটা আর কেউ না জানুক, বিমল জানে।
পরের সপ্তাহে, সোমবার, দ্বিতীয় ক্লাসটা সবে শেষ হয়েছে, পরেরটা শুরু হয়নি তখনও। এমন সময় হলধরদা, ওদের বাংলা বিভাগের প্রধান প্রফেসর লক্ষ্মীকান্ত ভট্টাচার্য মহাশয়ের খাস পিয়ন, হন্তদন্ত হয়ে এসে ক্লাসের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন, সুজয় চন্দ কে?
সুজয় কাছে আসতেই বলল, ‘লক্ষ্মীবাবু আপনাকে টিফিনের সময় ওনার ঘরে দেখা করতে বলেছেন।’
স্বভাব চরিত্রে, সুজয় ভাল ছেলে। ছাত্র হিসাবে আগের সেমেষ্টারের রেজাল্ট, ভালোর দিকে। তবুও হঠাৎ এমন জরুরি তলব কেন? সুজয় কি অজান্তে কোথাও কোনও অন্যায় করেছে? স্যারের তড়িঘড়ি সমনে ও বেশ ঘাবড়ে গেছে। এই বিষয়ে ক্লাসের বন্ধুরাও নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ব্যস্ত, সুজয়কে সরাসরি কেউ কিছু বলছে না। তবে ব্যতিক্রম, একমাত্র কণিকা। সুজয়কে বলে, ‘আগেই এত ভয় পাচ্ছিস কেন? দেখবি স্যার হয়তো নিজের প্রয়োজনেই তোকে ডেকেছেন।’ সাহস যোগানো, পাশে থাকার অঙ্গীকার, এটাই কণিকা।
টিফিনের সময় সুজয়ের সঙ্গে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়েছিল স্যারের ঘর অবধি। বিমল, কণিকা দুজনেই ছিল সেই দলে। ওদের সম্পর্ক গড়ার প্রস্তাব একতরফা হলেও স্বাভাবিক বন্ধুত্বে তার আঁচ পড়তে দেয়নি। চার-পাঁচজন বাইরে দাঁড়িয়ে, অবস্থা অনেকটা অপারেশন থিয়েটারের বাইরে উদগ্রীব রুগীর আত্মীয়স্বজনের মতো, উৎকণ্ঠার যেন শেষ নেই। মিনিট দশ-পনেরো পর, সুজয় যখন বেরিয়ে এল, ওর মুখটা থমথমে, ঠোঁটে বোকা বোকা হাসি। দেখে বোঝার উপায় নেই ঘরের ভিতরে কী ঘটেছে।
তাপস উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি রে, স্যার কেন ডেকেছিলেন? কী বললেন?’
গম্ভীর স্বরে, ‘ক্লাসে চল বলছি, জনে জনে বলে লাভ নেই, সবাইকে একসাথে বলবো।’ সুজয় এগিয়ে গেল ক্লাসের দিকে।
সুজয় হাই বেঞ্চে, ক্লাসের প্রায় সবাই ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে।
সুজয় বলল, ‘স্যার আমার দিকে তাকিয়ে প্রথমেই জানতে চাইলেন ফাইনাল পরীক্ষার আর কত দিন বাকি? কিছু বলার আগেই আবার প্রশ্ন, পড়াশুনা ঠিক মতো হচ্ছে তো? ওঁর সামনে ‘ভালো হচ্ছে’ বলার ধৃষ্টতা শোভন নয় বলে, একটু আমতা আমতা করছিলাম। তখনই উনি একটু উচ্চস্বরে বললেন, সেটা যদি বুঝেই থাকো, তবে এই সময়ে পত্রিকার পিছনে সময় নষ্ট না করে পড়াশুনায় মন দিলে ভাল হয় না? তোমরা এখন যথেষ্ট বড়ো হয়েছ, তা সত্ত্বেও আমাকে এইসব বলতে হচ্ছে কেন, বুঝতে পারছি না। তুমিই তো পত্রিকার সম্পাদক, তাই তোমাকেই বললাম। এই জন্যই ডেকেছিলাম, এছাড়া আমার আর কিছু বলার নেই।’
সুজয়ের মুখে কথাগুলো শুনে সকলের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, উনি চান না আর পত্রিকা বেরোক। বলাই বাহুল্য, ওদের কষ্ট হলো খুব।
পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ হবার পর থেকে বিমলকে এড়িয়ে চলছে কণিকা। ছন্দপতন হয়েছে সম্পর্কের। কেমন জানি সব উলটপালট হয়ে গেল। হয়তো বিমলও পাল্টে গেছে।
নিয়মমাফিক পরীক্ষা আরম্ভ হলো, শেষও হলো। অবশেষে, ফল ঘোষণা। জয়দেব প্রথম, বিমল দ্বিতীয়।
প্রথম হলে, চাকরি নিশ্চিত। হাতছাড়া হল সেটা। চাকরিটা খুব প্রয়োজন ছিল বিমলের। নিজের আত্মবিশ্বাসে বিরাট ধাক্কা। এবার কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। ভাগ্য সহায় বা চেষ্টার ফলশ্রুতিও হতে পারে। একটা স্কলারশিপ পেল, বিদেশে। বিমল ভুলে গেল সবাইকে, বিশ্ববিদ্যালয়কে, বন্ধুদের। মন থেকে সরিয়ে দিয়েছিল তাদের। বিমলের অতীত এখন শুধুই শূন্য।
প্রায় ছ’সাত মাস কেটে গেছে বিদেশে। খানিকটা ধাতস্থ হয়ে উঠেছে বিমল এই নতুন পরিবেশে। এক ঘরোয়া পার্টিতে একদিন হঠাৎ দেখা অসিতের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। প্রাথমিক আলাপচারিতার পর অন্যান্য বন্ধুদের কথা জানতে পেরেছিল। কে, কোথায় আছে জেনেছিল। অসিতের সঙ্গে অনেকেরই যোগাযোগ আছে। জেনেছিল সুজয়ের কথা, সে কোন এক মফঃস্বল কলেজে পড়ায়। প্রতীক স্কুল মাস্টার, বন্দনার সদ্য বিয়ে হয়েছে, স্বপন পত্রিকায় লেখে তবে নিয়মিত আয় সেরকম করতে পারেনা। শুধু জানতে পারেনি কণিকার কথা। হতাশ হয় বিমল, কিছুটা উদাসও। কণিকা যে অন্যদের থেকে তাকে একটা আলাদা জায়গা দিয়েছিল, সেই উপলব্ধিটা ওকে কষ্ট দিল।
বছর দুয়েক বিদেশে কাটিয়ে আর একটা ডিগ্রী নিয়ে কলকাতার একটা কলেজে অ্যাসোসিয়েট প্রোফেসরের চাকরি নিয়ে পাকাপাকি ভাবে ফিরে এসেছে বিমল। যোগাযোগ করে কয়েকজন পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে। ওদের থেকেই জানতে পারে কণিকার তখনও বিয়ে হয়নি, স্থায়ী চাকরি পায়নি। লিভ ভ্যাকেন্সিতে মাঝে মাঝে স্কুলে পড়ায়, তাছাড়া বেশিরভাগ সময়ে টিউশনি করেই হাত খরচ চালায়। বন্ধুদের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ রাখে না। শুনে খারাপ লাগে বিমলের। এমনটা যে কখনও হতে পারে ভাবতে পারেনি বিমল। কণিকার মতো এমন প্রাণ চঞ্চল, দৃঢ়চেতা মেয়ের কেন এই পরিণতি? যে কণিকা সবসময় সবার পাশে থেকেছে, তার পাশে আজ কেউ নেই। কণিকা কি তবে নিজের অন্তরে কণিকাকে অস্বীকার করেছে? হেরে গেছে নিজের কাছেই, না কি অন্য কিছু? এমন হাজারও প্রশ্ন ঘুরেছে বিমলের মাথায়। ভেবে কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি। চলার পথে বিধির বিধান অজানাই থেকে গেল বিমলের কাছে।
কালের প্রবাহে বদলে গেছে অনেক কিছুই। বদলেছে বিমলও। এতদিন যে বিমল সবাইকে ভুলে নিজেকে নিয়েই মেতে ছিল, সেই বিমল আজ রাতের অন্ধকারে স্টাডিরুমে বসে স্মৃতি রোমন্থন করে চলেছে। আবার নতুন করে দেখল সেই অতীতকে।
সকালে যখন ঘুম ভাঙল অপর্ণার তখন প্রায় পৌনে ছ’টা বাজে। বাইরে তখন আধো অন্ধকার। তাকিয়ে দেখল বিমল পাশে নেই। বাথরুমের দরজাও খোলা। আস্তে করে ঘরের বাইরে এলো অপর্ণা। বসার ঘর ফাঁকা। হরিও ওঠেনি। পাশের ঘরের দিকে এগোল, দেখল টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে আর টেবিলের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে রয়েছে বিমল। মুখে আলতো তৃপ্তির হাসি। সামনে খোলা লেখার খাতাটা। অপর্ণা হালকা পায়ে এগিয়ে গেল টেবিল ল্যাম্পের আলো নেভাতে, চোখ পড়ল খাতাটার দিকে, দেখল শেষ হওয়া গল্পের নীচে ছোট্ট করে লেখা ‘কণিকা তোমাকে’।