তীর্থের পথে পথে –৭ কন্যাকুমারী
তীর্থের পথে পথে –৭
কন্যাকুমারী
কোয়েলী ঘোষ
রামেশ্বরম থেকে বাস ছাড়ল সকালে । এবার যাব কন্যাকুমারী ,ভারতের শেষ দাক্ষিণাত্য বিন্দু । যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমেছে । ভারত সেবাশ্রম সংঘে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল । সামনে মন্দিরে সন্ধ্যারতি দেখে নিজের ঘরে এলাম । সেদিন আর কোথাও যাওয়া নেই ।সবাই বেশ ক্লান্ত । রান্না হবার পর খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম ।
কন্যাকুমারী মন্দির – খুব ভোরে স্নান করে বেরিয়ে পড়েছি অটো করে । বেশ কয়েক বছর আগে যখন এসেছিলাম তখন এত দোকান বাজার ছিল না । মন্দিরের পাশে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখলাম ।
পূর্বে বঙ্গোপসাগর , পশ্চিমে আরবসাগর আর দক্ষিণে ভারতমহাসাগরের মিলন সঙ্গমে দাঁড়িয়ে এক অপরূপ দৃশ্যের সাক্ষী হলাম ।সূর্য উঠল বঙ্গোপসাগরের বুকে ।
তার বর্ণিল ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল সাগরের জল । রঙ ছড়িয়ে পড়ল মনে । ঠিক তখনই মন্দিরে বেজে উঠল শঙ্খ ।
এবারে সাগরের পারে কুমারী আম্মান মন্দিরের দিকে এগিয়ে যাই । ৩০০০বছরের প্রাচীন এই মন্দিরে দেবী পার্বতী কুমারীরূপে অবস্থান করছেন ।
পুরাণের ইতিহাস ,রামায়ণ কাহিনী এখানে সঞ্চিত আছে ।
হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিশাল ভারতবর্ষে পুরাকালে রাজা ছিলেন ভরত । রাজার আট পুত্র ও একটি কন্যা । কন্যার নাম দিয়েছিলেন -” কুমারী ” । ভারতের দক্ষিণে তিনি রাজত্ব করতেন বলে এই অংশের নাম – কুমারী নাড়ু অর্থাৎ কুমারী অধিকৃত রাজা এবং এই শহরকে ‘কুমারিম পদি ‘ অর্থাৎ কুমারীর বাসস্থান বলা হয় ।
পরাশক্তি কন্যারুপ ধারণ করে তিনি এখানে তপস্যা করেছিলেন বলে এই স্থানের নাম কন্যাকুমারী নামে পরিচিত হয় ।
পুরাণ মতে বাণাসুর ব্রহ্ম।র বরে এমন শক্তিশালী হয়ে ওঠেন যে অত্যাচারিত দেবতা আর ঋষিগণ পার্বতীর কাছে আসেন । শর্ত অনুযায়ী একজন কুমারী নারী তাকে বধ করতে পারবেন ।
দেবী এখানে কুমারী রূপে বানাসুরের অপেক্ষায় থাকলেন । এদিকে শিব কুমারীকে তাঁকে বিয়ে করতে চাইলেন । এও এক চক্রান্ত কারণ বিয়ে হলেই বাণাসুরকে আর বধ করা যাবে না ।
নারদের পরিকল্পনায় সেই বিয়ের শুভক্ষণ পার হয়ে যায় ।দেবী এখানে কুমারী হয়েই থাকলেন এবং বাণাসুরকে বধ করলেন ।
বিবাহের জন্য যে খাদ্য দ্রব্য প্রস্তুত হয়েছিল তা পাথর হয়ে বালুকণায় পরিণত হয়েছিল তা আজও নানা বর্ণে রঞ্জিত কুমারী তীর্থের সমুদ্রতটে দেখতে পাওয়া যায় ।
অষ্টম শতাব্দীতে এই মন্দির নির্মিত হয় । এই দেবী এখানে আম্মান , বালাভদ্র ,পার্বতী , ভদ্রকালী রূপে প্রসিদ্ধ ,পূজিত হন । ৫১ টি শক্তিপীঠের অন্যতম এই মন্দির ।
মন্দিরে প্রবেশ করে দেবীর দর্শন করলাম । ভেতরের অন্ধকারে তেলের বাতি জ্বলছে । সেই আলোর ছটায় সুন্দর জীবন্ত হয়ে উঠেছে কালো মূর্তিখানি । পুজো দেবার নিয়ম বাইরে থেকে ।
দেবীর ভোগ পঞ্চামৃত , খিচুড়ি ,বড়া বা অপ্পম , ক্ষীর ও পায়েস …
মহালয়ার দিন থেকে শুরু করে বিজয়া দশমী পর্যন্ত নবরাত্রি উৎসব পালিত হয় । দেবী সজ্জিত হয়ে চতুর্দোলায় আরোহণ করেন এবং মন্দির অলিন্দে পরিক্রমা করেন । দেবী দর্শনে আসেন প্রচুর মানুষ ,ভোগ প্রসাদ গ্রহণ করেন ।
বৈশাখ মাসে পালিত হয় ” বৈশাখ ধ্বজারোহণ ”উৎসব । কার্তিক মাসে কৃত্তিকা উৎসব পালিত হয় ।
মন্দির প্রদক্ষিণ করে কালভৈরবের মূর্তি দর্শন করে ফিরে এলাম আশ্রমে ।
এরপর যাব কন্যাকুমারীর বিখ্যাত স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতি বিজড়িত বিবেকানন্দ রক ।
বিবেকানন্দ রক
সমুদ্রের উত্তাল জলরাশি ঠেলে ঠেলে লঞ্চ এগিয়ে চলেছে । আমরা সেই যাত্রী ,যেতে হবে আলোর সন্ধানে , অমৃতের পথে । নদী এসে মিশেছে সাগরে ,সাগর এসে মিশেছে মহাসাগরে — সেই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে ডাক এসে পৌঁছেছে মনের কোণে ।
এখানেই দূরে সাগরের বুকে জেগে আছে বিশাল প্রস্তরখণ্ড । ১৮৯২ সালের ২৪ শে ডিসেম্বর স্বামীজি পদব্রজে পৌঁছেছিলেন কন্যাকুমারী । ২৫শে ডিসেম্বর এই সমুদ্রের বুকে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে পার হয়েছিলেন এই জলরাশি । টানা তিনদিন ধ্যানমগ্ন ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ ।
তাঁরই স্মৃতিতে নির্মিত এই বিবেকানন্দ রক , কন্যাকুমারীর এক প্রধান দ্রষ্টব্য ।
অটো করে প্রথমে জেটিঘাট ,তারপর টিকিট কেটে লঞ্চে চড়তে হবে । লাইফ জ্যাকেট পরে আমরা লঞ্চে উঠলাম লাইন দিয়ে ।
লঞ্চ নিয়ে এসেছে এই বিবেকানন্দ রকে । এখানে দুটি মন্দির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে । একটি বিবেকানন্দ মণ্ডপম আর একটি শ্রীপদ মণ্ডপম ।
প্রথমে প্রবেশ করি কুমারী মাতার মন্দিরে । গ্রানাইট পাথরের তৈরি অপূর্ব কারু শৈলীতে তৈরি হয়েছে এই শ্রীপদ মণ্ডপম । গর্ভগৃহে শিলার ওপর আঁকা আছে তাঁর পদচিহ্ন ।
প্রণাম জানিয়ে একবার প্রদক্ষিণ করে নিই । মন্দিরের গাত্রে পাথরের ওপর পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছে দেবী কুমারীর নানা রূপ ।
এবার অনেকটা সিঁড়ি দিয়ে উঠে স্বামীজির কক্ষে প্রবেশ করি । স্বামীজির আট ফুট উঁচু দণ্ডায়মান মূর্তি প্রতিষ্ঠিত । স্বামীজিকে প্রণাম জানালাম ।
এই সময় কেউ মোবাইলে ছবি তুলতে গেলে ছুটে এলেন নিরাপত্তা রক্ষী ।জানালেন ছবি তোলা নিষেধ ।
তারপর প্রবেশ করলাম আরও একটি কক্ষে । সেখানে আছেন ধ্যানরত শ্রী রামকৃষ্ণদেব আর সারদা মায়ের তৈলচিত্র ।
ঠাকুর আর মাকে আমার অনন্ত কোটি প্রণাম জানিয়ে বাইরে এসে কিছুক্ষণ বসলাম ।
বেলুড় মঠের আদলে তৈরি এই বিবেকানন্দ রক । সিঁড়িতে বসে দেখছি অপূর্ব এক শোভা ।পুরো কন্যাকুমারী শহর এখান থেকে দেখা যাচ্ছে । অতল সমুদ্রের তিনটি সাগরের জল আলাদা রঙে মিশে যাচ্ছে ।
এই সেই স্বামীজির সাধনভূমি , এখানে এলে অদ্ভুত এক অনুভব হয় ।এবার ধীরে ধীরে প্রবেশ করি ধ্যান কক্ষে ।
অন্ধকার ঘরে এক শব্দ ওম …..ওম …. একটি চেয়ারে বসে দুটি চোখ বন্ধ করে পৌঁছে যাওয়া যায় অন্য অনুভবে , অন্য এক জগতে।
”সে অন্তরময় , অন্তরে মেশালে তবে তার অন্তরের পরিচয় ”
প্রাণকে চিনি স্পর্শযোগে ,তার স্পন্দন ,উত্তাপ ,কম্পন উপলব্ধি করে আর আত্মাকে চেনা যায় অস্পর্শযোগে ,যেখানে অন্য কোন সত্তা নেই ।তাকে জানতে নিমগ্ন হতে হয় । এই বোধের কথা লেখা যায় না ,এই অসীম অনন্ত পারাবারে এসে তাই বারে বারে নিজেকে হারিয়ে ফেলা , নিমজ্জিত হওয়া ।
”মন চলো নিজ নিকেতনে ,সংসার বিদেশে বিদেশীর বেশে ভ্রম কেন অকারণে ” এই গানটি মনে পড়বে নিশ্চয়ই ।
এবার ফেরার পালা ।
স্বামী বিবেকানন্দকে প্রণাম জানানোর সাথে সাথে আরও একজনকে প্রণাম জানাতে হয় যার উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল এই মন্দির , তিনি কর্মবীর একনাথ রানাডে । তিনি ছিলেন স্বামীজির ভাবধারায় উজ্জ্বল । তিনি মাত্র এক টাকার কুপন ব্যবস্থা করলেন ।সমগ্র ভারতবর্ষের রাজ্য হাত বাড়িয়েছিল । সমস্ত রাজনৈতিক বাধা দূর করে ১৯৭০ সালে এই মন্দির সবার জন্য খুলে দেওয়া হল ।
পাশেই রয়েছে তামিল কবি থিরুভাল্লুভারের বিশাল এক মূর্তি ১৩৩ ফুট উঁচু । ফেরার সময় আবার লঞ্চ থেকে নেমে দেখতে হবে ।
কেউ কেউ গিয়েছিলেন , কেউ কেউ নামেন নি । বেশিরভাগ মানুষ পায়ের যন্ত্রণায় কাতর । আমি আগে এসেছি তাই আর নামিনি ।
তখন সন্ধ্যে নেমেছে । স্নিগ্ধ এক আলোর ছটায় সূর্য পশ্চিমে অস্ত যাচ্ছে । অন্য এক আলোর অনুভবে ফিরছি কন্যাকুমারী জেটিঘাটের দিকে ।
” আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না ….ফুরাবে না …..”
সূর্যাস্ত দেখার জন্য এখানে সান সেট পয়েন্ট আছে কিন্তু আমরা সেখানে যাই নি ।
কেরলে কোভালাম বিচ আছে সবাই জানে কিন্তু এখানেও নির্জন কোভালাম বিচ আছে সে কথা অনেকেই জানে না ।
অটো করে গিয়েছিলাম কোভালাম বিচ কন্যাকুমারী । ছোট বড় কালো পাথর ছড়ানো আছে চারিদিকে । সমুদ্রের জল এসে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যাচ্ছে আর ফেনা ছড়িয়ে পড়ছে …
সূর্য অস্ত যাচ্ছে আরবসাগরে , এমন দৃশ্যটি ভিডিওতে ধরে রাখলাম ।
সাহেব মেমদের পুরো একটি পরিবার সেখানে বেড়াতে এসেছেন । তাঁরা অনুরোধ করলেন ছবি তুলে দেওয়ার জন্য । বেশ কিছু ছবি তুলে দিয়েছিলাম । সেই দেখে তাঁরা খুশি ।
ভারতবর্ষ খুব সুন্দর দেশ ,সে দেশ আতিথেয়তা জানে ,মেয়েরা খুব সুন্দর ,তাদের শাড়ি খুব পছন্দের … ইত্যাদি বলেছিলেন ।
কন্যাকুমারীতে আছে অনেক কিছু দেখার । কাছেই আছে গান্ধিমণ্ডপ ,গান্ধীজীর স্মৃতিসৌধ ।
চৈত্র পূর্ণিমার দিন পুবদিকে সন্ধ্যায় সমুদ্র থেকে চন্দ্রোদয় এবং পশ্চিমে সূর্যের ধীরে ধীরে অস্তমিত হওয়া আবার পরদিন সকালে পূর্ব দিকে সূর্যোদয় , সেইসঙ্গে পশ্চিমে চন্দ্রের অস্তগমন — এক স্বর্গীয় অলৌকিক দৃশ্য কন্যাকুমারীতেই দেখা যায় ।
কন্যাকুমারী থেকে ১৫ কিমি দূরে সুচিন্দ্রম মন্দির , যেখানে দ্রাবিড়ীয় শৈলীতে নির্মিত মন্দিরের কাজ অনবদ্য । পিলারে টোকা দিয়ে কান পাতলে সপ্তসুর শোনা যায় । ব্রম্ভা ,বিষ্ণু ,মহেশ্বর ত্রিমূর্তি আছে আর ১৮ ফুট উঁচু হনুমানজির মূর্তি আছে ।
কন্যাকুমারী শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে একটি দুর্গ আছে যেখান থেকে দেখা যায় শান্ত , সবুজে ঘেরা এক নির্জন বেলাভূমি ।
মাত্র ১৪ কিমি দূরে আরও একটি তাল আর নারকেল গাছে ঘেরা বেলাভূমি আছে । এখানে ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা যায় সুদূর বিস্তৃত নীল সমুদ্র আর সোনালী বেলাভূমি ।
কন্যাকুমারী এসে তিনদিন থাকলে সবকিছু দেখা যায় । ৬২ কিমি দূরে আছে জলপ্রপাত থিরুপারাপ্পু । পাচিপারা নদী এখানে ৫০ ফুট উঁচু থেকে আছড়ে পড়ছে ।
কন্যাকুমারী থেকে ৩৭ কিমি দূরে কেরলের ত্রাভাঙ্কর রাজাদের তৈরি পদ্মনাভ প্যালেস দেখার মত ।
এখানে সমুদ্র সৈকতে কিছু স্থানীয় মানুষ ঘুরে বেড়ান হাতে মুক্তোর মালা ঝুলিয়ে ।নানারকম মুক্তো নানা রঙের , দামে সস্তা । সামুদ্রিক স্টোনের তৈরি গয়না নিয়ে কেনার জন্য অনুরোধ করেন । সারি সারি দোকান শাড়ির ,নানা দক্ষিণের শাড়ি ,কেরালিয়ান কটন ।
আছে নানারকম মশলার দোকান ,প্যাকেটে বিক্রি হচ্ছে । দারচিনি ,এলাচ ইত্যাদি । ফুলের মত হার ঝুলছে ঠাকুরের জন্য , নানারকম পুজোর জিনিস ।
যে যার বাড়ির জন্য কেনাকাটি করছেন ।
সাউথ ইন্ডিয়ান খাবারের দোকান , তৈরি হচ্ছে ধোসা , বিরাট তাওয়া জুড়ে ।
গোটা সমুদ্র সৈকত একেবারে জমজমাট ।
কন্যাকুমারী থেকে পরের দিনের যাত্রা কেরলের পদ্মনাভ মন্দির । সেখান থেকে কোভালাম বিচ ছুঁয়ে একই দিনে কন্যাকুমারী ফেরা ।