কথা দিয়েছিলাম – বিক্রম ঘোষ পর্ব – ৩
কথা দিয়েছিলাম –
বিক্রম ঘোষ
পর্ব – ৩
সবাই তখনও অপলক চেয়ে রয়েছে প্রতীকের দিকে। বিমল বুঝতে পারে, প্রতীকের যুক্তিগুলো অবজ্ঞা করার নয়। আজকে প্রতীক যেন একেবারেই অন্য মানুষ। ও যে ভেতরে ভেতরে এমন একটা ভাবনা বয়ে বেড়াচ্ছে, আগে বুঝতে দেয়নি। ওর কথা বলার মধ্যে যে আত্মপ্রত্যয় লক্ষ্য করল, তাতে মুগ্ধ বিমল, মনে মনে সাধুবাদ জানাল। অন্তরের উপলব্ধি নিয়ে সহপাঠীদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, যদি তারা হাতে হাত মেলায় এই আশায়। প্রতীকের কথা বলা শেষ হতেই ওর চোখ মুহূর্তে চলে গিয়েছিল কণিকার দিকে। ও নিশ্চয়ই একটা মন্তব্য করবে। এক্ষেত্রে, কণিকা একটু বেশি সময় নিয়েছিল উত্তর দিতে। বলল, ‘ব্যাপারটা মন্দ নয় রে। চেষ্টা করে দেখলে ক্ষতি কি?’ শুধু এইটুকুই। বিমল অবাক হলো, এমন সংক্ষিপ্ত উত্তর একেবারেই কণিকা সুলভ নয়।
কণিকা মেয়েটা আবেগপ্রবণ। ভেবেচিন্তে কাজ করেনা, মন যা চায় তাতে সায় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা ওর খুব পছন্দের, সঙ্গে না হারার জেদ। সবসময় যে ও জিতে যায় এমন নয়, তবে উদ্যমে ঘাটতি পড়ে না কখনোই। চোখে, মুখে, এমনকি চেহারাতেও লড়াকু মনোভাবের ছাপ।
পাশে বসা বন্দনা পরক্ষণেই কণিকাকে বলে, ‘দ্যাখ, মুখে তুই যতটা সহজভাবে বলে দিলি, কাজে নামলে কিন্তু ততটা সহজ হবেনা। একটু ভেবেচিন্তে বল।’
বন্দনার কথাগুলো একেবারেই অবাক করার মতো নয়। বিমল ওকে প্রায় দু’বছর ধরে চেনে। ও যে এমনটাই বলবে, সেটাই স্বাভাবিক। ও এরকমই। সবসময় চিন্তা ভাবনা করে পা বাড়ায়। গতানুগতিক জীবন ছেড়ে বেরোতে চায় না, ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। নিতান্তই নরম স্বভাবের মেয়ে। চেহারাতেও তার প্রতিফলন স্পষ্ট।
বন্দনা আর কণিকার চেহারা, মানসিকতা, একে অপরের বিপরীত। অথচ দুজনের কী দারুণ বন্ধুত্ব। ওদের দু’জনকে দেখে অবাক লাগে বিমলের। কি ভাবে সম্ভব এমন দু’জন মানুষের বন্ধুত্ব!
জীবনে চলার পথে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম যে খাটেনা, সে অভিজ্ঞতা বিমল তখনও অর্জন করতে পারেনি।
প্রতীকের উত্তর শোনার পর সুজয় আর কথা বলেনি। কণিকার ছোট্ট মন্তব্য আর ওকেই ফিরিয়ে দেওয়া বন্দনার কথা ছাড়া কেউ একটা রা পর্যন্ত করেনি। কে জানে, বিমলের মতো অন্যরাও হয়তো নিজেদের মতো বিশ্লেষণে ব্যস্ত। মনের মধ্যে চিন্তার ঠেলাঠেলি চলছে নিশ্চয়ই। বিমলও নিজের ভাবনাতেই ছিল। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না, আদৌ কিছু বলাটা ঠিক হবে কিনা, এইসব।
তখনই স্বমহিমায় ফিরে আসে কণিকা। বন্ধুদের নীরবতা সহ্য করতে না পেরে বলে ওঠে, ‘কী রে? বোবার মতো সব চুপ করে বসে আছিস কেন? হ্যাঁ বা না, কিছু একটা বলবি তো।’
মানিক একটুও দেরি করেনি ফোঁড়ন কাটতে। ওকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি? তোর এমন কথা না শুনলে মনেই হয়না তুই আছিস। একদম ঠিক বলেছিস রে, দ্যাখ, সবগুলো কেমন বোকার মতো চুপ করে আছে।’ মানিকের কথা শেষ হতেই বন্ধুরা হেসে ওঠে। আর তাতেই আগুনে ঘৃতাহুতি। ‘মানিক, ইয়ার্কি মারিস না। সবসময়ে এসব ভাল লাগে না। একটা সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে কথা হচ্ছে, তার মধ্যে এরকম ফুট কাটবি না।’ বেশ জোরেই ধমক লাগালো কণিকা।
কণিকার ধমক দেওয়াটা বিমলের কাছে বাড়াবাড়ি মনে হলো। বন্ধুদের মধ্যে এমন দু’একটা হালকা কথা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। এ ধরণের টিপ্পনী সকলকে আনন্দ দেবার জন্য, অন্য কিছু তো নয়। অবশ্য এটাও জানে, কণিকার কাছে এসব রসিকতা বাচালতার নামান্তর।
বিমল একটু আগে ভেবেছিল, এই আলোচনায় ও ভাগ নেবেনা যতক্ষণ না পর্যন্ত ও নিজে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারছে। কিন্তু কণিকার প্রশ্নের ধরণ শুনেই বুঝেছে ও ভেতরে ভেতরে অস্থির। বন্ধুকে খানিকটা শান্ত করতে বলে, ‘প্রস্তাবে আমার সায় আছে। তবে সব দিক বিবেচনা করে এগোনোটাই বোধহয় উচিত কাজ হবে।’ এর বেশী কিছু বলার মতো বিকল্প বিমলের কাছে ছিলনা। ওর বক্তব্য তার সহপাঠিনীর মনে যে কী বার্তা গিয়েছিল সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা করতে পারেনি।
কণিকার কাছে ধমক খেয়ে মানিক আর কথা বলেনি আর স্বপন তো প্রথম থেকেই চুপ। বিমলের মন্তব্যের পরেও কোনো কথা বলেনি। স্বপন শুধু ঘাড় নেড়ে ওর বক্তব্যকে সমর্থন করেছিল।
বিমলকে সরাসরি কিছু না বললেও, ওদের সবার ব্যবহারে কণিকা যে মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল সেটা বোঝা গেল বিমলের বক্তব্য শেষ হওয়ার পরে। ফোঁস করে উঠল কণিকা, ‘তোদের দ্বারা কোনোদিন কিচ্ছু হবে না। সবসময় দেখি, দেখছি, ভাববো, এইসব কথা। কখনই কোন সদর্থক কথা শুনতে পাই না তোদের মুখে।’
কণিকা যেন এখুনি একটা স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চায়। কোনো কিছুতেই যেন ওর তর সয়না। বন্দনা আবারও কণিকাকে সংযত হবার অনুরোধ করে, ‘তুই এতো ছটফট করছিস কেন? ওদের ভাবার সময়টুকু অন্তত দে। কথায় আছে না, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া……,
কথাটা শেষ করতে দেয়নি বন্দনাকে, ঝাঁজিয়ে উঠেছিল কণিকা, ‘থামা তোর ভাষণ। ওসব কথা আমাকে শোনাবি না। আসলেই তোরা সব একেকটা ভীতুর ডিম।’
বিশাল বিশাল শালগাছের মাঝে এক আলো আঁধারি পরিবেশে আলোচনা এগিয়ে চলেছে। কণিকাকে আর রোখা যায়নি। ওই ছিল আলোচনার মধ্যমণি, প্রধান বক্তা। ওর কথাই গুরুত্ব দিয়ে শুনছিল সবাই। কী অফুরান প্রাণশক্তি মেয়েটার। বিমলের ভাল লাগে দেখে, হিংসেও হয়, ওরকম হতে পারেনা ভেবে। ও নিজে বরাবরের শান্ত প্রকৃতির।
বোলপুরের প্রকৃতিও যেন ওদের দোটানায় থাকা মনের ছবি তুলে ধরেছে। শাল পাতার ফাঁক গলে পড়েছে সূর্যের আলো, পাশেই কিছুটা জায়গা জুড়ে ছায়া। সে এক অদ্ভুত আলো ছায়ার সহাবস্থান। পারবে কি তারা পত্রিকাকে আলোর মুখ দেখাতে, নাকি ছায়ায় হারিয়ে যাবে তাদের সুপ্ত ইচ্ছে!
পত্রিকা প্রকাশ করার আলোচনায় ওরা এতটাই ডুবে ছিল যে অজান্তে কখন খাওয়া শেষ হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় এঁটো শাল পাতার থালাগুলো এলোমেলো হতেই ওদের সম্বিত ফিরল। ফিরতে হবে।
গুটিকয়েক বন্ধুদের দ্বারা যে এতো বড়ো কাজ সম্ভব হবেনা, সেটা বিলক্ষণ জানা ছিল ওদের। অতএব, ক্লাসের অন্যান্য সাহিত্যানুরাগী বন্ধুদের যুক্ত করতে হবে। সবাইকে নিয়েই এগোতে হবে। কোপাইয়ের পাড়ে ঘন্টা দুয়েকের আলোচনায় সিদ্ধান্ত হলো পত্রিকা প্রকাশ করার সাধ্যমতো চেষ্টা চালাবে সবাই। প্রস্তাবের উত্থাপক প্রতীকের চেয়ে কণিকার খুশি হওয়াটা নজর করল বিমল। লড়াইয়ে তার জয় হয়েছে। চড়ুইভাতির শেষবেলায় বন্দনাকে উদ্দেশ্য করে মানিকের উক্তি, ‘পারিব না ও কথাটি বলিও না আর’, কণিকাকে বাড়তি আনন্দ দিল।
কবি কবি চেহারার স্বপন কথা বলে কম। উচ্ছ্বাস একেবারেই দেখায় না। আলোচনাতে সেভাবে অংশগ্রহণ করেনি, মাঝে মাঝে দু’একটা ছোটোখাটো মন্তব্য ছাড়া। সেই স্বপন, হঠাৎ কটেজে ফেরার পথে গাইতে শুরু করল, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে।’ বন্দনা গলা মেলালো স্বপনের সাথে। এ যেন ওদেরই মনের কথা, ওদের প্রাণের কথা।
(ক্রমশ)