মা গো আনন্দময়ী @ গৌরী মৃণাল
মা গো আনন্দময়ী
@ গৌরী মৃণাল
আনন্দময়ীর আগমনে আনন্দে দেশ গিয়েছে ছেয়ে, – এবার আর কি করে সে কথা বলি! এ বছর তাঁর আরাধনা শুধু মনে আর কোণে , আনন্দের অন্তরালে । উপকরণ? সংযমের শুদ্ধতা, প্রতীক্ষার তপস্যা।
আজি শরততপনে প্রভাতস্বপনে কী জানি পরান কী যে চায় – তবু দেবীপক্ষের রাত পেরিয়ে ভোর এসে দাঁড়িয়েছে, কিশোরীর মতো চুপটি পায়ে। আকাশে এখন আলোর অমল কমলখানি ফুটি ফুটি হয়ে আছে । ‘আজি কে যেন গো নাই, এ প্রভাতে তাই জীবন বিফল হয় গো’ …. সবই তো আছে যেখানে যেমন, তবু কেন জানি না অকারণে ওই সুরটা আমার চারপাশে ঘুরঘুর করে, জানালার গ্রিলের ফাঁকে, ব্যালকনিতে অপরাজিতার লতায়, এমনকি কার্নিশে চড়াইদের তুর্কিনাচনের ছন্দেও। আমি আনমনে সুর বুলিয়ে যেতে থাকি, মধ্যম হয়ে কোমল ধৈবত আলতো করে নিষাদ ছুঁয়ে আসে ….ওই শেফালির শাখে কি বলিয়া ডাকে বিহগ বিহগী কি যে গায় গো! ….. বিভাস বাউল আমার সকালটাকে এক অন্য সপ্তকে নিয়ে যায়।
পাঁচদিনের পর নিরঞ্জন সারা হয়ে যাবে , তবু শূন্য মণ্ডপের অন্ধকার সরিয়ে রাখার রাতপাহারায় জাগ্রত যে প্রদীপ, তার কাজলমাখা চোখে এবার ঘুম নামছে শ্রান্তি আর তৃপ্তি নিয়ে। অজস্র ফুলের কুচি, মালার টুকরো ছড়িয়ে আছে আলুথালু রাজপথের এখানে ওখানে । শিউলিরা এখনো মাটির বুকে আদর মেখে ঘুমিয়ে কাদা, ঠিক যেন বছর পেরিয়ে মায়ের কোলে ফিরে আসা আমাদের মেয়েটি। কেনোপনিষদে ইন্দ্র দেখেছিলেন তাকে – বহুশোভমানাম্ উমাং হৈমবতীম্ । তিনি সৌম্যাৎ সৌম্যতরা, তিনি সকল শ্রী আর সৌন্দর্যের উৎস এবং আধার । তাই প্রায় পাঁচদিনের আদর আপ্যায়ন পূজার পরও বিসর্জনের মণ্ত্রে তাকে অনুনয়ের দাবী নিয়ে বলা যায় – সংবৎসর ব্যতীতে তু পুনরাগমনায় চ , এবার যাবে যাও, আগামী বছর আসার কথাটা তাই বলে ভুলে যেও না যেন।
সুন্দরবনের এক প্রান্তিক দ্বীপগ্রামে যাবার সুযোগ হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে , এমনই এক শারদীয় ছুটির সদ্ব্যবহারে। তখনই জেনেছিলাম দ্বীপটি একটু একটু করে ভাঙছে, প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে প্রায় নিঃশব্দে অল্প অল্প করে তলিয়ে যাচ্ছে চতুর্দিকের অথৈ জলরাশির মধ্যে । জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বঙ্গোপসাগরের জল উঠে আসছে দ্রুতগতিতে, সাথে তাল মেলাচ্ছে আমাদের গঙ্গা আর ওপারের মেঘনা ।অনবরত ধেয়ে আসা সাইক্লোন উপড়ে ফেলছে কত শত প্রাচীন বৃক্ষের আবাস।তবু ম্যানগ্রোভের শিকড় বিছিয়ে দিয়ে অবশিষ্টাংশকে দেখেছি অসহায় ভাবে নরম মাটিকে বুকে আঁকড়ে রাখতে । অনুচ্চকিত সেই আর্তনাদ জলের ছলছলাৎ শব্দ ভেদ করে বুকে এসে লেগেছিল, – যেতে নাহি দিব।
ওখানে নামার কথা ছিল না আমাদের , তবু সারেঙ্ রামপদ লঞ্চ দাঁড় করাল এক আঘাটার কাছে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে দূরচারী উদাস চোখে দক্ষিণবঙ্গের টানে বললো- দিদি, এককালে আমাদিগের ঘর ছিল এখেনে, আমাদিগের বাপ পিতেমোর ঘর। মীন ধরার জন্য জলে কুমির আর মধু তোলার জন্য ডাঙার দক্ষিণরায়ের সাথে লড়েও জিতিছিলাম। হিঁদু মোচলমান একসাথে পুজো পাব্বন করতাম , সত্যপীর, বনবিবি থেক্যে দুগ্গাপুজো – সব। একটাই হতো পুজো, গরিব মানষির গেরাম ! আইনুল চাচা বলির জন্য সবচে বড়ো চালকুমড়োটা মাচায় বেঁধে তুলে রাখতো । করিমভাই আনতো হেইয়ার গাছের সেরা কাঁদিটা । পুজোর কদিন সক্কলে একসাথে খিচুড়ি আর মুখিকচুর ডালনা …. গরীব মানষির গেরাম , কিন্তু সে এক অমিত্ত সোয়াদ !
চুপ করে যায় রামপদ । আজ জীবিকা আর জীবনের প্রয়োজনে সে পালিয়ে এসেছে ওই মৃত্যুছানিকে পেরিয়ে । কিন্তু যারা তা পারেনি তাদের মধ্যে আছে তারই সম্পর্কিত আত্মীয়, ভাই বোন, হয়তো বা সেই আইনুল চাচার ছেলে কিম্বা নাতি! আছে তো ?
সে কতো বছর আগের কথা। জানিনা জলের ওপর সেই দ্বীপ আজ আর ভেসে আছে কি না। যদি থাকে, আজও হয়তো মেঘেদের মানচিত্র ছিঁড়ে পুজোর গন্ধমাখা আকাশের নির্মল আলো বেঁচে থাকার আশ্বাস দিয়ে যায় সেখানে , শিউলি না থাক্, ভূখণ্ডের ভেসে থাকা মুখটিতে একগুচ্ছ কাশ তবু জেগে থাকে দল বেঁধে , আর হয়তো আজও ‘গরীব মানষির সেই গেরামে’ এক অদ্ভুত সম্প্রীতির পুজোয় কেউ গেয়ে ওঠে, ‘ ও মা আনন্দময়ী, আনন্দে রেখো সব্বজনে’ ! কে জানে!
@ গৌরী মৃণাল