“তীর্থের পথে পথে — ৪—৫ ——-মীনাক্ষী আম্মান মন্দির
তীর্থের পথে পথে –৪
কোয়েলী ঘোষ
কোদাইকানাল
মাদুরাই থেকে কোদাইকানালের পথে বাস চলেছে । দূরত্ব ১২৬ কিলোমিটার । খুব ভোরেই বেরিয়ে পড়েছি আমরা । গায়ে একটা শীতের চাদর জড়িয়ে নিয়েছি সবাই ।
দুপাশে ধানক্ষেত ,নারকেল গাছের সারি , কলাগাছ , ছোট ছোট ঘর বাড়ি পেরিয়ে যাচ্ছি ছবির মত । তারপর সমতল পেরিয়ে দুধারে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি দেখা গেল । এবার বাস উঠছে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে , চারিদিকে সবুজ অরণ্য ঘিরে আছে ।
তামিল ভাষায় কোদাইকানালের অর্থ ‘অরণ্যের উপহার ” । পালানি পাহাড়ের কোলে প্রকৃতি যেন উজাড় করে দিয়েছে ভালবাসা । কত নাম না জানা ফুল ফুটে আছে থরে থরে , অজানা পথিককে করে সম্ভাষণ । বারো বছর অন্তর এখানে ফোটে নীল রঙের নীল কুরিঞ্জি ফুল । প্রকৃতির দান ,অরণ্যের উপহার । অভিবাদন জানায় পাইন গাছের শ্রেণী । পাহাড়ের গা বেয়ে কুলকুল করে নামছে ঝর্ণা । কখনো কুয়াশার চাদরে মুখ ঢেকে যায় ,মেঘ উড়ে উড়ে যায় নীল আকাশে । সূর্যের স্নিগ্ধ নরম আলো এসে পড়ছে মুখে ।
পথে বাস থেমেছে ,সুন্দর এক প্রস্তর মূর্তি শ্রী গণেশের । পাহাড়িয়া মানুষেরা অজানা ফুল রেখে গেছে তাঁর পায়ের নিচে । কেউ চায়ের দোকানে চা ,কেউ ডাব খেয়ে আমরা আবার বাসে চড়ে পৌঁছে গেছি লেকের ধারে ।
লেকের ধারে পথ ,পথের ধারে ধারে সারি সারি দোকান ।
মনে পড়ছে অনেক পুরনো স্মৃতি ।সেদিন আমরা মেয়েদের নিয়ে এসেছিলাম । এই লেকে শিকারায় বোটিং করেছি । তখন এই পাহাড়ে থেকেছি ।
খাওয়াদাওয়া সেরে উৎসাহীরা নেমে পড়েছে লেকের জলে । চারিদিকে সবাই ছড়িয়ে গেছে । আমরা মহিলারা খুঁজছি টয়লেট । খুঁজতে খুঁজতে এসেছি এক পার্কে । এই পার্কে না এলে দেখা হত না এত হরেক রঙের গোলাপ ফুল , লাল লাল অজানা ফল , এত সুন্দর সাজানো পাহাড়ের বুকে গাছপালা । গাছ দিয়ে তৈরি অপূর্ব শিল্পকর্ম ।
পাহাড়িয়া মানুষেরা সেই ফল নিয়ে বিক্রি করতে বসেছেন । নানা রকম ফল টুকরো ,ওপরে নুন ,মশলা ছড়িয়ে পাতায় করে দিচ্ছেন । এক পাতা খেয়ে দেখি অপূর্ব তার স্বাদ ।সেসব অজানা ফল সমতলে মেলে না ।
এখানে দেখার জন্য আছে বিয়ার শোলা ফলস , সিলভার কাসকেড ঝর্ণা , গুনা কেভ । এখান থেকে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বাসে একদিনে ঘুরিয়ে আনা হয় পাঁচটি পয়েন্ট । পাহাড়ি পথে হেঁটে যাওয়া যায় ককার্স ওয়াকে । সেখান থেকে দেখা যায় উপত্যকার ভিউ ।
এতো সময় হাতে নেই । এখানে পাহাড়িরা গরম উলের সোয়েটার নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেছে । নানারকম চকোলেট তৈরি হয়। ওজন করে বিক্রি হচ্ছে । কিছু চকোলেট কেনা হল । তারপর ফেরা । দুটি বাস আগেই চলে গেছে আর আমাদের বাস একটু পরেই বিকল । নেমে দাঁড়িয়েছি এক দোকানের সামনে । এমন সময় বাজনা বাজিয়ে একদল পাহাড়ের মানুষ চলেছেন সেজেগুজে । প্রথমে ভাবলাম বিয়ে তারপর দেখি খাট সাজিয়ে মৃতদেহ নিয়ে চলেছে আনন্দিত আত্মীয় স্বজন ।
বৃদ্ধ এক মানুষ জানালেন , এই পৃথিবীর দুঃখ শোক থেকে মুক্তি পাওয়া গেল বলে সবাই আনন্দিত হয়ে বাজনা বাজায় । খুব ভালো লাগলো এই আধ্যাত্মিক ভাবনা ।
বাস ততক্ষনে চালু হয়ে গেছে । তাড়াতাড়ি বাসে উঠে পড়ি ।
তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে পাহাড়ের কোলে । রঙের বর্ণালী ছড়িয়ে পড়ছে অপরূপ সুন্দর অরণ্য , উপত্যকায় , নীল আকাশ জুড়ে । তার কিছুটা রঙ মেখে ফিরে আসা , কিছু রঙ রয়ে গেল মনের মধ্যে ।
“তীর্থের পথে পথে — ৫
মীনাক্ষী আম্মান মন্দির
——————————
এখানে জেগে আছে এক ভারতবর্ষ । জেগে আছে ইতিহাস , শতাব্দী প্রাচীন । দাঁড়িয়ে আছি মীনাক্ষী মন্দিরের সামনে । কি তার বৈভব! কি তার বৈচিত্র্যময় কারুকার্য!
পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম কি আশ্চর্য এই মন্দির ।
রাতের ক্লান্তি মুছে গিয়েছে সকালের আলোর কিরণে । সকালে উঠে স্নান সেরে আমরা অটো করে বেরিয়ে পড়েছি মন্দিরের পথে।
দুপাশে সারি সারি দোকান সাজানো । মাদুরাই সিল্ক শাড়ি এখানে বিখ্যাত ।
দক্ষিণী মহিলারা গাঁথছেন সুন্দর গোড়ের মালা বিক্রির জন্য। সেই সাজে সুন্দর হয়ে ওঠেন তাঁরা ।
বহুদূর থেকে দেখা গেল এই অপরূপ মন্দিরের শোভা ।
এখানে মীনাক্ষীরূপে পার্বতী আর সুন্দরমরুপে শিব পুজিত হন ।
মন্দিরের পাঁচটি প্রবেশপথ । মীনাক্ষী মন্দিরটি পনের একর জমিতে তৈরি ।
সাড়ে চার হাজার পিলার আর বারোটি টাওয়ার । চারটি অসাধারণ শিল্পমণ্ডিত ও কারুকার্যখচিত গোপুরম দেখলে মুগ্ধ আর বিস্মিত হতে হয়। মন্দিরের গাত্রে খোদাই করা আছে উজ্জ্বল এনামেলের বর্ণে রাঙানো রামায়ন, মহাভারত, বেদ, পুরাণের নানা দেব-দেবীর মূর্তি ও কাহিনীর দৃশ্যাবলী যার তুলনা নেই।
কবি কালিদাস রঘুবংশে এই পাণ্ড্য রাজবংশের উল্লেখ করেছেন।
পাণ্ড্য বংশের রাজা মলয়ধবজ ছিলেন নিঃসন্তান। পুত্রকামনায় তিনি এক যজ্ঞ করেছিলেন । যজ্ঞ শেষে এক কুমারী কন্যা যজ্ঞ উঠে আসেন । মীন অর্থাৎ মাছ ,সেই মাছের মত টানা চোখ থেকে তাঁর নাম হল মীনাক্ষী।
পরে ‘ সুন্দরম ‘ নামে শিবের সাথে সাক্ষাৎ হয় এবং বিবাহ হয়। নানা কাহিনী কথিত আছে।
বিশাল বড় দরজা দিয়ে প্রবেশ করলাম । প্রবেশের মুখে বড় বড় হাতী দাঁড়িয়ে । হাতি মঙ্গলের বলে মানা হয় ।
বাঁদিকে প্রসাদ কিনলাম পুজোর জন্য । তারপর মন্দিরের ভেতরে গিয়ে দেবী মীনাক্ষীকে দর্শন করলাম ।
দেবী কৃষ্ণ পাথরের , প্রদীপের আলোয় সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন । পুজো , আরতি দেখার পর মন্দিরটি ঘুরে ঘুরে দেখছি ,এমন সময় কানে এলো ক্লাসিক্যাল সংগীত ।
মাটিতে বসে আছেন শিল্পী , পাশে দুজন দাক্ষিণাত্যের যন্ত্র আর বাদ্য নিয়ে বসেছিলেন । সেই সকালে এক শিল্পীর ভারতীয় রাগ সংগীত শুনছি স্তব্ধ হয়ে .. সেই আত্মনিবেদনে যেন বাঙময় হয়ে উঠছেন দেবী । সুরের ঝঙ্কার উঠছে সারা মন্দির ছুঁয়ে ..বাজছে হৃদয়ের তন্ত্রীতে ।
কোথাও হারিয়ে গিয়েছিলাম । এই ভারতবর্ষের ইতিহাসে, এই প্রাচীন মন্দিরের শিল্প কীর্তির, এই রাগসঙ্গীতের সমর্পণে, এই দেবীর বেদীতলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে, টলমল করে উঠল অশ্রুজল। তারও গভীরে অবগাহন করে প্রণত হলাম।
কোয়েলী ঘোষ।
ছবিঋণ — কৌশিক পাল ।