স্যেন নদী ———— বানী দেব

আমায় ডুবাইলি রে আমায় ভাসাইলি রে
অকুল দরিয়ার বুঝি কুল পাইলাম না
—————————————-
স্যেন নদী / বানী দেব
—————————————-
ক্লামার্ট, ফ্রান্স, ১৬. ১. ২০২০
—————————————-
সকাল ৭.৩০ টার ট্রেনে ক্লামার্ট থেকে নত্রোদাম চার্চ দেখতে যাব বলে রুষার সংগে বেড়িয়েছি। বাড়ি থেকে স্টেশন যেতে সময় লাগে ১০ মিনিট। অথচ হাতে আছে মাত্র আট মিনিট, তাই দৌড়। ওভার ব্রিজ ক্রশ করছি, ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়ল। লাফিয়ে লাফিয়ে নামলাম। অবশেষে ট্রেনে উঠে পড়া গেল।
মনপারনাসে নেমে আবার ছুটলাম মেট্রো ধরতে। সব মেট্রো এখনো চলছে না। পেনসন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ফরাসি নাগরিকদের এক আন্দোলন চলছে সরকারের বিরুদ্ধে। মেট্রো, বাস, ট্রেন প্রায় সব বন্ধ ছিলো। কিছু সরকারি বাস চলাচল করছিল। জনজীবনে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে কম না এর জন্য। কিন্তু আন্দোলনকারীরা অনড়। সরকারও তার সিদ্ধান্তে অটল। তবে সম্প্রতি নাগরিকরা বুঝি নরম হতে শুরু করেছে। মেট্রোও সবে খুলতে শুরু হলো।
৪ নং মেট্রোর দিকে এগোলাম। সেন্ট প্লাসিদি থেকে রুষাও উঠলো আমাদের সাথে। ওর অফিস অবশ্য আরও অনেক দূর। আমরা প্রচন্ড ভিড় ঠেলে তিনটে স্টেশন পরে নেমে পড়লাম, সেন্ট মিশেলে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে খোলা আকাশের নীচে একটা কাফে চোখে পড়লো। গলাটা একটু ভিজিয়ে নিতে ইচ্ছে হলো। কাফের কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। ফাঁকাই ছিলো। ওয়েটার এসে অর্ডার নিয়ে গেল। মেইন রোডের দু’ধারে সুন্দর সুন্দর বাড়ি, দোকান। ক্যাপিচিনোয় চুমুক দিয়ে জিপিএস ঘাটাঘাটি করি, তা সে ব্যাটা উত্তর দেয় না। পথ দেখাবি তো নাকি? ফরাসিরা আবার ইংরেজি জানেনা। কি জ্বালা! কাফের মালিকের সাথে কথা বলতে গিয়ে বুঝেছি একে দিয়ে হবে না। কাফে থেকে বেড়িয়ে ফুটপাতের ডান দিক ঘেঁষে
হাঁটতে থাকি। সবে সকাল সাড়ে আটটা, আঁধার যাবো যাবো করেও পথ ছাড়ে না। এরই মাঝে উমনো-ঝুমনো মেঘ বৃষ্টির ফাঁক গলে এক গালে টোল ফেলে আকাশ হেসে উঠলো। দেখি সামনে এক বাস স্ট্যান্ড। উল্টো দিকের বিরাট চত্বর জুড়ে চিনা পর্যটকদের ভীড় গাইড কে ঘিরে। এক গীর্জার আকৃতির দরোজার সামনে দেবদূতের স্ট্যাচু। এর নিশ্চয় এক গল্প আছে। সে কাহিনি জানা হলো না। সে যাক ছবি তুলে নিলাম। কিন্তু নত্রোদাম কোন দিকে? ফুটপাত ঘেঁষে এক ভ্যান গাড়ি, এক যুবক মালপত্র নামাচ্ছিল, বুঝলাম ডেলিভারি দিতে এসেছে সে। এরা ঘুরে ঘুরে মালপত্র দেয় যখন নিশ্চয় জানবে নত্রোদামের ঠিকানা। ছেলেটি ইংরেজি না জানলেও বুঝে নিল আমরা পর্যটক। তাই নত্রোদাম নাম শুনে অত্যন্ত বিনীত ভাবে ফরাসি ভাষায় আকারে ইংগিতে যা বললে তাতে বোঝা গেল এই চওড়া রাস্তার ওপারে গেলেই নজরে পড়বে নত্রোদাম। খুশি হয়ে তাকে জানালাম – মেসি বুকু। ( অনেক ধন্যবাদ)।
রাস্তা পেড়িয়ে হাঁটতে থাকি, এখানে সব উল্টো নিয়ম। ফুটপাতে তুমি বামদিকে নয়, ডানদিকে হাঁটবে। এ অভ্যেস রপ্ত করতে একটু সময় লেগেছে বটে। কিছু দূর হাঁটতে এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ফরাসি ভদ্রলোককে জানতে চাই, নত্রোদাম আর কতো দূর? কফির কাপ হাতে তিনি এগিয়ে বিনীত জবাব দিলেন, সামনের বাড়িটিই নত্রোদাম। সদালাপী এই ভদ্রলোক আমরা ভারতীয় জেনে খানিক গল্প করে নিলেন। এর আগেও দেখেছি ফরাসিরা অত্যন্ত ভদ্র আর মিশুকে। বাঙালীদের মতো একটু বেশ আড্ডাবাজ। ওদের এই আড্ডা প্রবনতাকে বেশ ভালোই লাগে। কথায় কথায় জানালেন, নত্রোদামে শর্টসার্কিটের কারণে আগুন লেগে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ফলে এর মেরামতি চলছে। ভেতরে ঢোকা যাবে না। পর্যটকরা বাইরে থেকে ছবি টবি তুলছে। গীর্জার সামনে দিয়ে স্যেন নদী বয়ে চলেছে। বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় প্রথম সূর্যের আলো অপূর্ব এক মায়াবী রেশমি ওড়না জড়িয়ে দিয়েছে। নদীর প্রতি অমোঘ টানে ছুটে গেলাম তার কাছে। আকাশে সূয্যি কি যে রং এর খেলায় মেতেছে। রাস্তার উপর ব্যস্ত জনজীবন, ছুটন্ত গাড়ির উজ্জ্বল আলো, আর এই মহাজাগতিক আলো পথের উপর পড়ে থাকা বৃষ্টি কনায় মিলে মিশে এক আলো আঁধারী স্বপ্ন বুনে চলেছে। নদীকে ঘিরেই তো প্রাচীন সভ্যতা গুলি গড়ে উঠেছিলো। তা নদীর দান তো কম নয়। আবার তার আরেকটি রূপের কথাও অজানা নয় কারো। বহুবার নিশ্চয় এর প্লাবনে ফরাসী জনজীবন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। তাই নিশ্চিত, নিরাপদ জীবনের তাগিদে নদীতে বাঁধ দিতে হয়েছে। স্যেন নদীর আগের রূপ তো জানা নেই কিন্তু এখন তো আর তাকে নদী বলতে মন চায় না। এ যেন এক পরিচ্ছন্ন খাল বলে বোধ হয়। ফরাসিরা আমায় মার্জনা করবেন। এর দু ধার উঁচু করে বাঁধানো। নদীর বুকে অনেক জলযান, ফ্লোটেল, আইফেল টাওয়ার থেকে দেখেছিলাম। এ নদীর বিপদ নেই, উত্তাপ নেই, কথা নেই কোনো, হয়তো ভাষা বুঝি না, বিদেশীনি কিনা। ছোট বেলায় দুটি নদীর হাত ধরে বড়ো হয়েছি, অজয় আর গঙ্গা। তারপর আরও কতো নদী দেখলাম, হুগলি, ময়ূরাক্ষী, কাঁসাই, হলদি ব্রম্মপুত্র। এমন সব নদীর কুলু কুলু বুকে মাঝিমাল্লারা ভাটিয়ালি গেয়ে ওঠে – ” “আমায় ভাসাইলি রে আমায় ডুবাইলি রে
অকুল দরিয়ার বুঝি কুল পাইলাম না। ”
স্যেন নদী কে নিয়ে এমন গান গাওয়া যায় না। ফরাসিরা নিশ্চয় তাকে নিয়ে গান বেঁধেছে, কিন্তু সে গান আমার শোনা হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *