অনুগল্প : ভাঙা আয়না ——— •• রাজ দত্তগুপ্ত ••
অনুগল্প : ভাঙা আয়না
•• রাজ দত্তগুপ্ত ••
রুকসার যখন ছ’ বছর বয়স, মতি বিবি তার মেয়েকে রেখে আল্লার কাছে চলে যায় যক্ষ্মা রোগে । সেই থেকে রুকসার মা-বাবা বলতে সংসারে একাই মুজিব, পেশায় রাজমিস্ত্রি । মুজিব একা সব সামলাতে পারছিল না, তাই রুকসাকে স্কুল থেকেও ছাড়িয়ে নিল সে । ঘরেই থাকুক মেয়েটা, ঘরের কাজ করবে । মুজিবকে সকাল আটটা/নটার মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হয় । ফিরে আসার তাড়া থাকে, মেয়েটা যে বাড়িতে একা । মুজিবকে পাড়া-প্রতিবেশী সবাই বলেছিল, আবার সাদী করতে । কিন্তু তার আদরের দুলালী রুকসাকে হয়তো নির্যাতন সইতে হবে, এই ভয়ে মুজিব আর এসব নিয়ে চিন্তা করেনি । মা-মরা মেয়েটাকে বস্তির সবাই খুবই ভালোবাসে, কেউ না কেউ এসে রোজ একবার খোঁজ নিয়ে যায় । রুকসা ভালোই আছে, সারা দিন টুকটাক কাজ করে, দুপুরের রান্না, রাতের রান্না সব একাই করে । রাতে বাড়ি ফিরে মুজিব রাতের রুটিটা করে বাপ আর বেটির জন্য।
দশ বছর কেটে গেল একই ভাবে । রুকসা এখন ষোলো বছরের কুমারী । গায়ের রংটা যেন মতিবিবিই দিয়ে গিয়েছিল, গোলাপের নির্যাস দিয়ে তৈরী । রুপসার রূপ দেখে অনেক প্রতিবেশী তাদের আত্মীয়র মধ্যে সম্বন্ধ করতে চেয়েছিল, কিন্তু মুজিব পরিস্কার সবাইকে একই কথা বলে দিয়েছে, আঠারো বছর না হলে সে মেয়ের সাদী দেবে না।
এ বস্তিতে সব ছেলেরাই রুকসাকে খুব ভালোবাসে, বোনের মতোই স্নেহ করে, কিন্তু বাইরে থেকে এই ছেলেদের যে সব বন্ধুরা আসে, তারা অত বোঝে না, রুপসার বুকের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে । তাই পাড়ার ভাই-দাদারা রুকসাকে সাবধান করে দেয়, ঘর থেকে কম বেরোতে।
একা একা রুকসা তার রুপ দেখে ঘরে বসে একটা ভাঙা আয়নায় । আয়নাটা ভেঙে যাওয়ার সময় রুকসা খুব কেঁদেছিল, কারণ ওটা ওর মা ওকে দিয়ে গিয়েছিল । এই ভাঙা আয়নাটা রুকসার সব সময়ের সাথী, তাই সে এটাকে সালোয়ারের পকেটে রেখে দেয় ।
মুজীবের দুজন বিশ্বস্ত মিস্ত্রি আছে, জাফর আর অমর । মুজীব মাঝে মধ্যে এদেরকে রুকসার কাছে পাঠায়, কিছু টাকা পয়সার দরকার পড়লে । জাফর বা অমর কেউ এলে রুকসা ভীষণ খুশি হয়, কিছুক্ষণ তো একটু গল্প করা যাবে । পাড়ার ভাই-দাদারাও কিন্তু ব্যাপারটা নজর রাখে, যারা থাকে ।
গত বুধবার সকালেই অমর হাজার দুই টাকা নিয়ে গেল, মুজীব পাঠিয়েছিল । মুজীব পাঠালে সকাল সকালই পাঠায়, কারণ মাল কিনতে লাগে । আজ দুপুরে রুকসা তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে শুয়ে নানা অঙ্গভঙ্গি করে তার প্রিয় ভাঙা আয়নায় নিজের রুপ দেখছিল, চোখটাও লেগে এসেছিল । কিছুক্ষণ পরে দরজায় মৃদু আওয়াজ শুনতে পেল, কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে । রুকসা ‘কে কে’ বলতে বলতে ঘুম চোখে দরজা খুলে দিল, দেখলো খুব সুন্দর একটা ছেলে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে বলছে, ‘তূমি রুকসা বহিন তো, আমার নাম সিরাজ, চাচা আমাকে পাঠিয়েছে, হাজার তিনেক টাকা দিবার জন্য’ । রুকসা সিরাজের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘ঘরে এসে বস’ । সিরাজ ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসল । রুকসা অন্য ঘরে চলে গেল টাকা গুণতে । যাবার আগে সিরাজকে সে একগ্লাস জল আর দুটো বাতাসা দিয়ে গেল । কিছুতেই রুকসা টাকা ঠিক মত গুণতে পারছে না, বারবার সিরাজের মুখটা ভাসছিল । অনেক কষ্টে রুকসা টাকাটা গুণে এঘরে এসে সিরাজের হাতে দিয়ে বলল, ‘দেখে নাও ঠিকমত । অমরদা বা জাফরদা এলো না কেন, ওরাই তো আসে’। ‘আসলে ওরা চাচার সঙ্গে কাজে লেগে আছে’ । একটু পরে সিরাজ আবার বললো, ‘আমি এলাম বলে তুমি রাগ করলে কি’ । রুকসা লজ্জায় লাল হয়ে গেল, মাথা নীচু করে বলল, ‘না না, এমা ছিঃ ছিঃ, একথা কেন…’ সিরাজ রুকসার হাতটা ধরে ফেলল হঠাৎ, রুকসার ভালো লাগলো। টাকাগুলো পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে সিরাজ রুকসার বুকে হাত দিল । ঝটিতে পিছিয়ে গেল রুকসা, চেচিয়ে উঠলো, ‘শয়তান, তোর পেটে পেটে এতো!’ সিরাজ রুকসার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই, রুকসা পাজামার পকেট থেকে ভাঙা আয়নার তীক্ষ্ম দিকটা সজোরে বিধিয়ে দিল সিরাজের তলপেটে । একবার, দুবার, তিনবার । অনেক বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল সিরাজ, কিন্তু রণচন্ডী রুকসার কাছে সে হেরে গিয়ে মৃত্যুকেই বরণ করতে বাধ্য হল । ভাঙ্গা আয়নায় মাখামাখি রক্ত, রক্ত ঝরছে রুপসার হাত দিয়ে, সমস্ত জামাকাপড়, ঘর মেঝে রক্তে ভাসছে । রুপসা কাঁদতে কাঁদতে দরজায় গিয়ে চিৎকার করে প্রতিবেশীদের জড় করলো।
এর পরের ঘটনা খুবই স্বাভাবিক । আত্মসন্মান রক্ষা করতে এই নাবালিকা রুকসার জেল হয়েছিল মাস ছয়েক।
সিরাজের কথা এই প্রসঙ্গে একটু না জানালেই নয় । তাহার রুপ ও কথাবার্তার চাতুর্যে অনেক নারীই ধর্ষিতা হয়েছে, এ তথ্যও পাওয়া যায় ।
রুকসা এখন ভালো আছে । তাহার দুই কণ্যা সন্তান সস্নেহে তাহার এবং স্বামী সৈয়দের সঙ্গে দিনযাপন করিতেছে ।
(এ ঘটনার সময়কাল ত্রিশ বছর আগের, যদিও ঘটনা সম্পূর্ণ কাল্পনিক)