ইতিহাসের ঐতিহ্যে অাজও উকি মারে বালুরঘাট পতিরামের জমিদার বাড়ির দূর্গাপূজা
১৮ই সেপ্টেম্বর, বালুরঘাটঃ হাতিশালে হাতি। ঘোড়াশালে ঘোড়া, না, এসব আজ আর কিছুই নেই। আছে শুধুই স্মৃতি। তাও ধুসর। তবু এ বাড়ির আনাচে কানাচে আজও ঝলকে ওঠে জমিদারির নীলরক্ত। সময়ের ভারে জমিদারির তেজ ধুয়ে মুছে গেলেও আজও শতাব্দি প্রাচীন লাল বাড়ির গায়ে চুঁইয়ে পড়ে আভিজাত্যের অহংকার। সেই অহংকারের মুকুটে অলংকার রয়েছে জমিদার তকমা থাকা পালক, তা সত্বেও একদিকে স্বদেশি আন্দোলন অন্যদিকে শান্তিনিকেতনে পড়তে গিয়ে স্বয়ং রবিন্দ্রনাথের সংষ্পর্ষে এসে মনটাকে এলোমেলো করে দিলেও পারিবারিক দুর্গোৎসবকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোন খামতি রাখেননি ২৫০ বছরের প্রাচীন পতিরামের জমিদারের ঘোষেদের বর্তমানে দায়িত্বে থাকা সাগর ঘোষের বাবা গোবিন্দলাল ঘোষ। যদিও সাগর বাবু নিজেও কম যান না। দেশের রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লি রাধাকৃষননের হাত থেকে পুরষ্কার গ্রহন থেকে দেশের ততকালিন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকও করেছিলেন তিনি। আমেরিকা থেকে উচ্চ শিক্ষা সেরে জেলায় ফিরে, এইখানকার কৃষকদের জমি এক ফসলি থেকে দো ফসল, এমনকি তিন ফসল ফলানোর জন্য কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কাজ বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন তিনি।
শরতের শুরুতেই কাশ ফুল ফোটা মানেই বনেদি বাড়ীগুলির দুর্গাপূজার প্রস্তুতি শুরু। তাই এবারও শরতের আকাশে পেজা তুলার মতো মেঘের আনাগোনা শুরু হতেই জন্ম অষ্টমীর দিন দুর্গা কাঠামোয় প্রতিমা নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাটের পতিরাম ঘোষ বাড়ীর মন্দিরে। প্রতি শরতে আগমনীর সুরে জমজমাট হয়ে ওঠে পতিরামের জমিদার ঘোষ বাড়ির দুর্গো পুজোয় দশমিতে এখনও পুুুুজিত হয় ডিংগি ( নৌকা)।
আজ থেকে ছয় পুরুষের জমিদারির পর , বর্তমানে ঘোষ বাড়ীর গৃহকর্তা পেশায় শিক্ষক সাগর কুমার ঘোষ, বংশের প্রথা মেনে প্রতিবছরই দুর্গাপূজার আয়োজন করে চলেছেন। আনুমানিক ২৫০ শতাধিক বছর পূর্বে শুরু হওয়া এই দুর্গাপূজায় প্রথম দিকের বছর গুলিতে পতিরাম এলাকার এই জমিদার বাড়ীতে দেবী দুর্গা পূজিত হত টিনের চালা ঘরে। সেই সময় ঘোষ বাড়ীর পূর্ব পুরুষদের ছিল ধান, চালের ব্যবসা। নদীপথে সেই ধান চাল রপ্তানি হত তত্কালীন পূর্ব বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে। সেকালে দুর্গাপূজার সপ্তমী থেকে নবমী তিন দিন ধরে মঙ্গলচন্ডীর গানের আসর বসতো জমিদার বাড়ীর মন্দির চত্বরে। প্রথম দিকে পতিরামের এই জমিদার বাড়ীর দুর্গাপূজায় বলি দেওয়ার প্রথা প্রচলিত থাকলেও দিন বদলের সাথে সাথে সেই প্রথা এখন অতীত। বর্তমানে দেবী এখানে নিয়ম মেনে পূজিত হন। তবে পূজা উপলক্ষ্যে এখন অার ঘোষ বাড়ী চত্বরে বসে না মঙ্গলচন্ডী গানের আসর।
বাড়ীর প্রবেশপথের ডান দিকের ধ্বংসাবশেষ কাছারি বাড়ীটি আজও ঘোষ বাড়ীর জমিদারির স্মৃতি চিহ্নের গরিমা বহন করে চলেছে। তবে পূজা শুরুর প্রথম দিককার টিনের চালা মন্দির ঘরটি পরিবর্তিত রুপ নিয়েছে দালান মন্দিরে। তবে পরিবর্তন ঘটেনি সেকালের প্রথাগত নিষ্ঠার ঐতিহ্যবাহী জৌলুসতায়।
তবে দিন বদলের সাথে সাথে জমিদার ঘোষ বাড়ীর দুর্গাপূজার রীতিতে কিছু পরিবর্তন ঘটলেও সেকালের সাবেকি আনার ছোয়া আজও বর্তমান ঘোষ বাড়ীর দুর্গা পূজায়। কুলদেবতা হওয়ার কারনে পঞ্চমীর দিন ঘোষ বাড়ীতে নারায়ণ পূজা দেওয়ার রীতি এবং ষষ্ঠীর দিন বেলগাছতলায় দেবীর বোধন হয় এখানে। অন্নভোগ দেওয়ার প্রচলন নেই, তাই ফল-মূল-লুচি-পায়েস প্রভৃতি ভোগ হিসাবে নিবেদন করা হয় ঘোষ বাড়ীর দুর্গাকে। বর্তমানে জমিদারি না থাকলেও জমিদার বাড়ী হিসাবে খ্যাত ঘোষ বাড়ীর বর্তমান কর্তা সাগর কুমার ঘোষ জানান তার এক ছেলে এবং এক মেয়ে। তারা কর্মসুত্রে শহরে বাইরে থাকলেও পুজোর সময় তারা বাড়ির পুজোতে হাজির হতে ভুল করে না বলে তিনি জানান।
ঐতিহ্য ও আন্তরিকতার মিশেলে সেরা বনেদি পতিরামের জমিদার ঘোষেদের অট্টলিকার জানলার খুলে যাওয়া খড়খড়ির ফাঁকে উঁকি মেরে যায় ইতিহাস। পুজোয় ঘরে ফেরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আত্মীয়পরিজন। জমজমাট হয়ে ওঠে বছরভর ঝিমিয়ে থাকা জমিদারবাড়ি। সারা বছরের প্রতিকুলতা কাটিয়ে উঠে জমিদারি ঐতিহ্যের অহংকার বজায় রাখতে বদ্ধ পরিকর দক্ষিন দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট এলাকার পতিরামের জমিদার বংশধরেরা।