কিভাবে কাশ্মীর ভারতের অংশ হলো, আর্টিকেল ৩৭০, ৩৫A কেন, জেনেনিন কাশ্মীরের ইতিহাস
১২ সেপ্টেম্বর, দিল্লিঃ গোটা দেশে এখন একটাই শব্দ- চায়ের আড্ডা থেকে বাড়ির রান্নাঘর একটাই শব্দ এখন শোনা যাচ্ছে কাশ্মীর কাশ্মীর কাশ্মীর। এতদিন কাশ্মীরে জঙ্গি হামলা হলেও কাশ্মীর শব্দটা সারা ভারতবাসীর কাছে এতটা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেনি, যতটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে গত ছ’মাসে। পুলওয়ামা হামলা কিংবা 370 35a ধারা তুলে নেওয়া, এখন ভারতবাসীর চর্চার বিষয়ে সামনে এসেছে এই উপত্যকা।
কিন্তু কি করে কাশ্মীর ভারতের অংশ হলো? কি করেই বা কাশ্মীর ভারতে প্রবেশ করল? কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের এত লেগে থাকার কারণই বা কি? সব ইতিহাস এখন আমরা তুলে ধরছি আপনাদের সামনে।
কাশ্মীরের ইতিহাসঃ পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত কাশ্মীরে হিন্দুধর্ম ও পরবর্তীতে বৌদ্ধধর্ম প্রভাব বিস্তার করে, নবম শতাব্দীতে গিয়ে কাশ্মীর উপত্যাকায় শৈবধর্মের উত্থান ঘটে। 1339 সালে প্রথম মুসলিম শাসক শাহ মীরের হাত ধরে কাশ্মীরে ইসলামের বিস্তার হতে থাকে। এই সময় অন্যান্য ধর্মের প্রভাব হ্রাস পেলেও তাদের অর্জনসমূহ হারিয়ে না গিয়ে বরং মুসলিম অনুশাসনের সঙ্গে মিশে কাশ্মীরি সুফিবাদের জন্ম হয়। পরবর্তী সময়ে 1839 সাল পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় 500 বছর মুসলিমরা কাশ্মীর শাসন করে। 1819 সালের শেষাংশে রণজিৎ সিংহের নেতৃত্বে শিখরা কাশ্মীর দখল করে 1846 সালে কাশ্মীরের তৎকালীন রাজা ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গেলে রাজ্যটি ইংরেজদের হস্তগত হয়। তবে একটি চুক্তির মাধ্যমে গোলাপ সিং ব্রিটিশদের কাছ থেকে 75 লাখ টাকা এবং সামান্য বার্ষিক চাঁদার বিনিময়ে কাশ্মীর ক্রয় করেন এবং নতুন শাসন হয়, 1947 সাল পর্যন্ত গোলাপ সিংয়ের বংশধরেরাই কাশ্মীর শাসন করেছেন।
রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সূচনাঃ 1925 সালে কাশ্মীরের রাজা হরি সিংহ এবং 1947 সালে ভারত স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত তিনি ছিলেন কাশ্মীরের শাসক ভারত বিভাগের অন্যতম শর্ত ছিল ভারতের দেশীয় রাজ্যের রাজারা তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারবেন, আবার চাইলে স্বাধীন ভাবে রাজ্য পরিচালনা করতে পারবেন। কিন্তু একটি বিষয় লক্ষনীয় যে হরি সিং ছিলেন হিন্দু রাজা, তিনি চাইছিলেন ভারতের সঙ্গে থাকতে কিন্তু কাশ্মীরের জনসংখ্যা 85% ছিল মুসলিম জনগণের বিরাট একটি অংশ চাইছিল পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে এমনই এক দোলাচলের 1947 সালের 22 শে অক্টোবর পাকিস্তান সমর্থিত পাকিস্তানের পশতুন উপজাতিরা কাশ্মীর আক্রমণ করে, এরপর কাশ্মীরিদের সঙ্গে পশতুনেরা যুদ্ধ শুরু করলে, কাশ্মীরের রাজা হরি সিং ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন এর সহায়তা চান। বিনিময়ে হরি সিংহ 26 অক্টোবর এমন একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন যে, তাতে উল্লেখ ছিল ভারতের সঙ্গে যোগ স্বাক্ষরিত হওয়ার পরেই ভারতীয় সেনারা কাশ্মীরের প্রবেশ করে, অপরদিকে কাশ্মীরের পাকিস্তান প্রান্ত দিয়ে পাকিস্তানী সৈন্য প্রবেশ করে।প্রায় চার বছর যুদ্ধ চলার পরে 1952 সালে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে যুদ্ধবিরতি হয়। যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব অনুসারে কাশ্মীর থেকে উভয় দেশের সৈন্য প্রত্যাহার ও গণভোটের আয়োজন এর কথা বলা হয়। ভারত প্রথমে সৈন্য প্রত্যাহার করতে রাজি হলেও গণভোটের আয়োজনে অসম্মত হয়। ভারতের ধারনা ছিল মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরে গণভোট হলে তারা পাকিস্তানের পক্ষে যোগ দেবে অপরদিকে পাকিস্তান কাশ্মীর থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে রাজি হয় না। ফলে উভয় দেশেই তখন থেকেই নিজের নিজের দখল করা এলাকায় কাশ্মীরে সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছে দুইদেশ। পরবর্তী সময়ে কাশ্মীর নিয়ে 1965 সালে এবং 1999 সালে দুই দেশের মধ্যে আবারও যুদ্ধ হয়, যা এখনও চোরা গোপ্তা চলছে প্রতিদিন।
ভারত কি চায়ঃ 1949 সালের 17 অক্টোবর, ভারতের সংবিধানের 370 ধারা সংযোজিত হয়। এই ধারা অনুসারে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। একই সঙ্গে কাশ্মীরে নতুন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও কেন্দ্রের কোনো ভূমিকা থাকবে না। এছাড়া রাজ্যের স্থায়ী অধিবাসী ছাড়া সেখানে জমি ক্রয়, রাজ্যের চাকরিতে আবেদন ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা হয়। এমনকি জম্মু-কাশ্মীরের কোন নারী রাজ্যের বাইরে কাউকে বিয়ে করলে তিনি সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন। এই আর্টিকেল 370, 35A তুলে দিল মোদি সরকার, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস বরাবরই 370 ধারা মেনে চলার ক্ষেত্রে তুলনামূলক নমনীয়তা দেখিয়েছে। তবে ক্ষমতাসীন বিজেপি বিগত নির্বাচনের সময় ঘোষণা করেছিলেন তারা ক্ষমতায় এলে 370 ধারা বাতিল করা হবে, মূলত সেই প্রতিশ্রুতি মেনেই রাষ্ট্রপতি বিশেষ আদেশের মাধ্যমে বিজেপি সেই পরিকল্পনায় বাস্তবে রূপ দিল।
কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের অবস্থানঃ 1947 সাল থেকেই কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশ হওয়া উচিত এবং এ কারণেই হাজার 1947 সালের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তানের পশতুনরা পাকিস্তান দখলের চেষ্টা চালায়। কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের নীতি হলো কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নয়, বরং এটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কার একটি বিতর্কিত ভূখণ্ড আর কাশ্মীরের ওপর পাকিস্তানের দাবি সব সময় অনেক বেশি। কারণ রক্তে-মাংসে জীবন-যাপনে সংস্কৃতিতে কিংবা ভূগোল আর ইতিহাসে তারা পাকিস্তানের মানুষের অনেক কাছের। পাকিস্তানে এসেছে বহু শাসক কিন্তু পাকিস্তানের এই নীতির কোন পরিবর্তন হয়নি আজও, আর এই ভাবেই কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান লড়াই চলছে সেই থেকে। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ইতিহাস 1990 সাল পর্যন্ত ভারতীয় কাশ্মীর বেশ শান্ত ছিল, মুসলমান ও কাশ্মীরি পণ্ডিত শান্তিতে সহাবস্থান করেছিল, তৈরি হয়েছিল এক অসাধারণ অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। যাকে বলা হয় “কাশ্মীরীয়াদ” কিন্তু ধর্মের বিষ মেরে ফেলল প্রতিবেশীসুলভ ভালোবাসাকে। এরপরেই পাক উস্কানিতে 1990 সালের 19 শে জানুয়ারি থেকে কাশ্মীরের হিন্দু পণ্ডিতদের নিধন শুরু হলো। আর আগের বছর থেকেই ফারুক আব্দুল্লাহ সরকার সেখানকার কুখ্যাত জঙ্গিদের জেল থেকে ছাড়তে শুরু করলো। অন্তত 70 জন জঙ্গি 1989 এর জুলাই থেকে নভেম্বর এর মধ্যে কাশ্মীর জেল থেকে ছাড়া পায়। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিহত হওয়াটা তখন যেন ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। 1990 এর 4ঠা জানুয়ারি হিজবুল মুজাউদ্দিন এর আবতাব একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে ঘোষণা করলো সমস্ত হিন্দুদের কাশ্মীর ছাড়তে হবে। আল-সাফা বলে অন্য একটি সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হল, ক্রমশ কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ঘরের দরজায় দরজায় কাশ্মীর ছাড়ার নোটিশ ঝুলিয়ে প্রক্রিয়া শুরু করা হলো। চুপ ছিল ফারুক আব্দুল্লাহ সরকার, এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারও তখন উপত্যাকা জুড়ে শুধু একটাই আওয়াজ উঠলো “পন্ডিত মুক্ত কাশ্মীর” গঠনের। রাস্তায় রাস্তায় এবং উপত্যাকা জুড়ে এমন মিছিল আর স্লোগান এই কাশ্মীর ও তার “কাশ্মীরিয়াত” আগে কখনো দেখেনি। পালিয়ে যাওয়া পণ্ডিতদের অভিযোগ কাশ্মীরের সমস্ত মসজিদ একসঙ্গে ঘোষণা করল যে কাশ্মীরকে পাকিস্তান বাড়াতে হবে। নিজেদের সন্তান ও জীবন বাঁচাতে তখন হাতের কাছে যে যা পেল তা নিয়েই বেশিরভাগ পন্ডিত তাদের বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে পড়িমড়ি করে পালাতে শুরু করলো যেনতেন প্রকারে সেখান থেকে পালাবার জন্য তাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। ধীরে ধীরে পুরো কাশ্মীর চলে গেল কাশ্মীরি মুসলমানদের অধীনে। আর্টিকেল 370 জোরে কাশ্মীরের অভ্যন্তরে অশান্তি সৃষ্টির প্রচেষ্টা এবার পুরতরে শেষ করে দিল ভারত সরকার।